Image description

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার সদস্য এরসিন সেলিক জানিয়েছেন, ইসরাইলি প্রশাসন গ্রেটা থুনবার্গের চুল ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ইসরাইলি পতাকায় চুম্বন করতে বাধ্য করেছে। তাকে মারধর করা হয়েছে। পর্যাপ্ত খাবার এবং জল দেওয়া হয়নি৷ নাৎসিদের মতো আচরণ করেছে জায়নবাদীরা৷ বিধ্বস্ত গ্রেটাকে টানতে টানতে জনসমক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ যেহেতু আটক ব্যক্তিদের মধ্যে গ্রেটা সবচেয়ে পরিচিত মুখ, তাই তাকে টার্গেট করে হেনস্তা করেছে ইসরাইল।

গ্রেটা এবং তার সঙ্গীদের সঙ্গে যা করা হয়েছে, তার সহস্রগুণ বেশি অত্যাচার প্রতিদিন, প্রতিবেলায় সহ্য করতে হয় ফিলিস্তিনিদের৷ বছরের পর বছর। মাসের পর মাস৷ দশকের পর দশক। ইসরাইল এমনই এক রাষ্ট্র।

বছর দুয়েক আগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর স্ত্রী সারার ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা এবং অফিস ম্যানেজার জিপি নাভোন ইসরাইলের সেনাবাহিনীর কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, অবরুদ্ধ গাজার বাসিন্দাদের হত্যা না করে বাঁচিয়ে রেখে বাড়ি বাড়ি ঢুকে অত্যাচার করা হোক। আটক ফিলিস্তিনিদের জিভ যেন না কেটে ফেলা হয়। কারণ ইসরাইলিরা তাদের আর্তনাদ উপভোগ করতে চান। আটক আরবদের কান এবং চোখ যেন আস্ত রাখা হোক, যাতে তারা দেখতে এবং শুনতে পান তাদের নির্যাতিত হতে দেখে ইসরাইলিদের উল্লাস।

গ্রেটার হেনস্তার কথা বলা জরুরি, কারণ ইসরাইল একজন আর্ন্তজাতিক সেলিব্রিটিকেও রেয়াত করে না। যারা দিনের পর দিন খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষারত নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে খুন করে, হাসপাতালে বোমা ফেলে, চিকিৎসকদের নির্যাতন করে হত্যা করে, হাজারে হাজারে শিশুকে গুলিতে, বোমায় এবং অনাহারে হত্যা করে, যারা জেলখানায় বন্দি ফিলিস্তিনিদের উপর কুকুর লেলিয়ে দেয়, তারা যে গ্রেটা থুনবার্গকেও হেনস্তা করবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

ইসরাইলের এমন বিকৃত উল্লাস ২০২৩ সালে শুরু হয়নি। বছরের পর বছর এমন বিকৃত উল্লাসের দৃশ্য গোটা পৃথিবী দেখেছে। ২০১৪ সালে ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র জনতার ওপর যখন বোমা পড়ছে, রকেট বৃষ্টি হচ্ছে, ঝলসে যাচ্ছে ফিলিস্তিনি শিশুর দল, সেই অপরূপ মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য তখন উঁচু পার্বত্য এলাকায় ইসরাইলিদের ভিড়। সোফায় বসে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার এবং পানীয় নিয়ে তারা ‘উপভোগ’ করছেন মারণ উৎসব। আন্তর্জাতিক মিডিয়া তখনই এই বীভৎসতার খবর করেছে। আমরা অনেকে হয়তো দেখিনি। আমাদের চোখ খুলতে এক লাখ মানুষকে মরে যেতে হয়।

অনেকে বলার চেষ্টা করেন এই তথাকথিত 'যুদ্ধ' শুরু হয়েছে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। হামাসের আক্রমণের মাধ্যমে। মিথ্যে কথা৷ এই সংঘাত শুরু হয়েছে ১৯৪৮ সালে। ফিলিস্তিনিদের নিজভূমে পরবাসী করে, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। '৪৮ সালের সেই প্রথম 'নকবা' থেকেই শুরু হয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেই লড়াই চলছে। আগামীতেও চলবে। একজন ফিলিস্তিনি বেঁচে থাকা পর্যন্ত এই স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হবে না।

এই মুক্তিযুদ্ধে কখনও ছায়া দিয়েছে আরাফতের পিএলও বা ফাতাহ্, কখনও হামাস। কোথাও কমিউনিস্ট পিএফএলপি। কোথাও মাওবাদীদের ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট। কোথাও পিপিপি বা অন্য কেউ। জেনিন, নাবলুস, গাজায় অসংখ্য তরুণ কোনো মতাদর্শের তোয়াক্কা না করেই স্বাধীনতার যুদ্ধ লড়তে হাতে তুলে নিয়েছেন বন্দুক বা পাথর। দশকের পর দশক ফিলিস্তিনকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইসরাইল এখনও সেই যুদ্ধে জিততে পারেনি।

বছরের পর বছর ঝাঁকে ঝাঁকে ফিলিস্তিনকে খুন করেছে ইসরাইল। খুব আগের কথা যদি বাদও দিই, কেবল ২০১৮ সালে ২৯৯ জন খুন হয়েছেন। ২০১৯ সালে ১৩৩ জন। ২০২১ সালে ৩১৩ জন। ২০২২ সালে ২০৪ জন। শয়ে শয়ে খুন। বছরের পর বছর। মৃতদের মধ্যে অসংখ্য শিশু। কাজেই ফিলিস্তিনিরা নয়, যুদ্ধের নামে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করেছে ইসরাইল। ক্ষুদিরাম বসু বা ভগৎ সিং যেমন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেননি। তাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন চাপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। তারা প্রতিরোধ করেছিলেন। মার খেতে খেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ভারতবাসীর হয়ে প্রতিরোধ করেছিলেন। অসম যুদ্ধে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও লড়ে গিয়েছিলেন। ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামীরাও তাই করছেন।

এই অসম যুদ্ধ শুধু ফিলিস্তিনের নয়। গোটা বিশ্বের আপামর মুক্তিকামী জনতার। ফিলিস্তিনই আজকের ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামে যখন বৃষ্টির মতো নাপাম বোমা পড়ছিল, তখন লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, বার্লিন, কলকাতা ভেসে গিয়েছিল যুদ্ধবিরোধী জনস্রোতে। বহু দশক পরে আজ সেই একই দৃশ্য দেখছে পৃথিবী। ইতালির শ্রমিকরা ধর্মঘটে গোটা দেশ স্তব্ধ করে সংহতি জানাচ্ছেন 'উন্মুক্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে' পরিণত হওয়া গাজাকে। এথেন্সের শ্রমিক ও ছাত্ররা বন্দর অবরোধ করে বলছেন, ইসরাইলে যুদ্ধাস্ত্র পাঠানো যাবে না। লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে জনজোয়ার। বার্লিনে পুলিশের বীভৎস নির্যাতনের মুখে লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নামছেন৷ ফ্রান্সে ব্যারিকেড ফাইট হচ্ছে। জনস্রোতে ভেসে যাচ্ছে ব্রাসেলস থেকে ব্রাজিল, কিউবা থেকে কলম্বিয়া, মেক্সিকো থেকে মিলান।

ফিলিস্তিনের লড়াই কেবল মুসলমানের নয়। এই লড়াই মজলুম জনতার। পৃথিবীর সব নিপীড়িত মানুষের। মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু, ইহুদি, বৌদ্ধ- সকলের। ফিলিস্তিনি গেরিলাদের পপুলার ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা জর্জ হাবাস নিজে ছিলেন একজন খ্রিস্টান৷ জেরুজালেমের যে আস্তাবলে যিশুর জন্ম হয়েছিল বলে মনে করা হয়, সেখানে এখন একটি চার্চ আছে। সেই চার্চের ভিতরে একটি সুড়ঙ্গ। প্রতি বছর বড়দিনে সেই সুড়ঙ্গের মুখে একটি তারা আলো দিয়ে সাজানো হয়। মনে করা হয়, এই সুড়ঙ্গের পাশেই ছিল সেই প্রাচীন আস্তাবল, দুই হাজার বছর আগে যেখানে মা মেরির কোল আলো করে জন্মেছিলেন যিশু। গত দুই বছর বড়দিনে ওই চার্চে কোনো আলো জ্বলেনি। পাদ্রীরা জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের শরিক তারাও, তাই গণহত্যার প্রতিবাদে আলো জ্বলবে না চার্চে। এই লড়াই ইহুদিদেরও। লন্ডনে আমি মিছিলে হাঁটি জায়নবাদ বিরোধী ইহুদিদের সঙ্গে। মিছিলে হাঁটি হিটলারের হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে জীবন কাটানো ইহুদি বাপমায়ের সন্তানদের সঙ্গে। তাদের হাতে থাকে প্যালেস্টাইনের পতাকা। গোটা পৃথিবীতে জায়নবাদবিরোধী ইহুদিরা পথে নামছেন ফিলিস্তিনের পক্ষে, গণহত্যার বিরুদ্ধে। তারা এই সংগ্রামের শরিক।

ফিলিস্তিন এই সময়ের কষ্টিপাথর। গোটা পৃথিবী আড়াআড়ি দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। হয় গণহত্যার বিরুদ্ধে, অথবা পক্ষে। মাঝামাঝি কিছু নেই৷ এই কষ্টিপাথর মানুষ চেনার আমোঘ হাতিয়ার। আমি যে মতাদর্শের কথাই বলি না কেন, আমার হাতে যে রঙের নিশানই থাকুক, আমি কি ফিলিস্তিনের পক্ষে? আমি কি গণহত্যার বিরুদ্ধে? এই চেয়ে জরুরি রাজনৈতিক প্রশ্ন আর কিছু নেই।

 

অর্ক ভাদুড়ি

লেখক: কলকাতা ও লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিক, গবেষক, অ্যাক্টিভিস্ট