Image description
 

আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী সুখরঞ্জন বালির তৎকালীন রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক গুম হওয়া, ভারতে পাচার হওয়া এবং আবার বাংলাদেশে ফিরে আসা-এ ঘটনা যেন সিনেমার কাহিনি থেকে কোনো অংশে কম নয়। সুখরঞ্জন বালির ঘটনা বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের নির্মম এক চিত্র। রাষ্ট্রপক্ষের নির্দেশমতো মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় গুম হয়েছিলেন সুখরঞ্জন বালি । শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে এসে সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী হাসিনাসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগে মামলা করেছেন তিনি। তার কিছুদিন পর একই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আরো তিনজন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন, যেখানে তারা অভিযোগ করেন,জোরপূর্বক ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য আদায় করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এটি হাসিনা-আমলের বিচারব্যবস্থার মুখোশ উন্মোচনকারী সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলোর একটি।

 

 

 
 

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ভুয়া সাক্ষী দাঁড় করানো এক অন্ধকার অধ্যায়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মানুষকে হত্যার হুমকি দিয়ে, কখনো পরিবারকে বিপদের মুখে ফেলে, কখনো অর্থ ও চাকরির লোভ দেখিয়ে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমননীতির কবলে ফেলে ভুয়া সাক্ষ্য আদায় করা, পুরো বিচারব্যবস্থার ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

 

একটি মামলায় সাক্ষীর ভূমিকা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। সাক্ষ্য ছাড়া আদালতের বিচার কার্যত অসম্পূর্ণ। সাক্ষ্যই আদালতের কাছে ঘটনার বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু যখন সেই সাক্ষ্য সত্য নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রভাব ও রাজনৈতিক ইচ্ছায় সাজানো হয়, তখন বিচারব্যবস্থা আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার থাকে না; বরং তা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রতিশোধের নাট্যমঞ্চ।

 

তৎকালীন সময়ে অসংখ্য মামলায় বিরোধী দলের কর্মী, সাধারণ নাগরিক এমনকি নিরপেক্ষ মানুষকেও ফাঁসাতে সাক্ষী জোগাড় করা হয়েছে। কারো কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে, কারো পরিবারকে বিপদে ফেলার ভয় দেখানো হয়েছে। এসব সাক্ষ্য আদালতে হাজির করা হয়েছে। আর দলান্ধ, স্বার্থান্ধ, বিবেকবর্জিত এক শ্রেণির বিচারক জেনে-বুঝে এসব মিথ্যা সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে সরকারের নির্দেশমতো রায় দিয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন বিচারিক হত্যার ন্যক্কারজনক অনেক উদাহরণ।

 

মিথ্যা সাক্ষীর এই সংস্কৃতি শুধু নির্দিষ্ট মামলার আসামিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং পুরো সমাজে এক ভয়াবহ আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে। আদালতকে মানুষ সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে দেখে, কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় সেই আদালতের ওপরই জনগণের বিশ্বাস নষ্ট হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিরপেক্ষ মনে করার সুযোগ থাকে না। একজন নিরপরাধ যখন মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে সাজা পায়, তখন প্রকৃত অপরাধী থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর ফলে রাষ্ট্রে অপরাধচক্র শক্তিশালী হয় আর বিচারব্যবস্থা হয়ে পড়ে দুর্বল।

সুখরঞ্জন বালির ঘটনা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়—ক্ষমতার লোভে যখন সত্যকে হত্যা করা হয়, তখন বিচারব্যবস্থা শুধু নামেই থাকে, কাজে তা রূপ নেয় এক রাজনৈতিক নাটকের মঞ্চে।

 

এখন সময় এসেছে এই অশুভ প্রথাকে ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবেই সমাপ্ত করার। এ জন্য প্রথমত, সাক্ষী সুরক্ষা আইনকে কার্যকর ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে একজন সাক্ষী রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক চাপের মুখেও নিরাপদে সত্য কথা বলতে পারেন। দ্বিতীয়ত, স্বেচ্ছায় ভুয়া সাক্ষ্যদাতাদের কঠোর শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে কেউ আর রাজনৈতিক সুবিধার জন্য নিজের বিবেককে বিকিয়ে না দেন। তৃতীয়ত, বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে, যাতে আদালত শুধু আইনের চোখ দিয়েই ঘটনা দেখে, ক্ষমতার চশমায় নয়।

 

ন্যায়বিচার হলো রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি। সেই প্রাণশক্তি যদি ভুয়া সাক্ষ্যের মিথ্যার বালুচরে দাঁড়িয়ে থাকে, তবে রাষ্ট্র নিজেই হয়ে পড়ে ভঙ্গুর। গণতন্ত্র দুর্বল হয়, নাগরিক আস্থা ভেঙে পড়ে আর আইনশৃঙ্খলা নামক কাঠামো একদিন ধসে পড়ে। তাই মিথ্যা সাক্ষ্যের রাজনীতির অবসান শুধু ন্যায়বিচারের জন্য নয়, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য।

লেখক :তাহসিনা জামান