
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) এবং হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ ও গণনা নিয়ে যা হলো তা অনভিপ্রেত ও অগ্রহণযোগ্য। ভোট গ্রহণে কিছুটা অব্যবস্থাপনা ছিল। গণনার ক্ষেত্রেও চরম অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। ভোটের তৃতীয় দিনের প্রথমার্ধেও ফলাফল পাওয়া যায়নি। ভোট গুনতে দেরি হওয়ার মূল কারণ যন্ত্রের (ওএমআর) বদলে হাতে গণনা। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ভোটের দিন হাতে গোনার দাবি মেনে নেওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতার পরিচায়ক। কয়েকটি প্যানেলের দাবির মুখে হাতে ভোট গণনার সিদ্ধান্ত হলেও সেজন্য প্রস্তুতি ছিল না। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ভিপি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতু নির্বাচিত হওয়ার পথে রয়েছেন। জিএস, এজিএসসহ বাকি সব পদে ইসলামী ছাত্রশিবির মনোনীত প্রার্থীরা এগিয়ে রয়েছেন।
গণনার একপর্যায়ে শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার পরে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার। ভোট গ্রহণের দিন বৃহস্পতিবার বিকালে তিনজন শিক্ষক দায়িত্ব থেকে সরে যান। এই চার শিক্ষক মূলত বিএনপিপন্থি বলে পরিচিত। ভোট গ্রহণের শেষ দিকে ছাত্রদল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়, পুনর্নির্বাচন দাবি করে। আবার ছাত্রদলের এজিএস প্রার্থী ভোটের ফলাফল মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পরে প্রতিদ্বন্দ্বী আরো চারটি প্যানেল একই ঘোষণা দেয়। অবশ্য ফলাফলের ট্রেন্ড বলছে, বর্জনের ঘোষণা দেওয়া প্যানেলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বেশ দূরে ছিল। পুরো ঘটনাপ্রবাহ জাকসু নির্বাচনকে একধরনের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
এর আগে ডাকসুতে সবাইকে চমকে দিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির যে ভূমিধস বিজয় পেয়েছে এবং এই সময়ের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, সে খবর এখন পুরোনো। তবে ডাকসুতে ছাত্রশিবিরের চেয়েও বড় বিজয় পেয়েছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ক্যাম্পাসে কোনো রকম অঘটন ছাড়া উৎসবের আমেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হবে, তা ১৩ মাস আগে সম্ভবত কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। যে ক্যাম্পাসে পেশিশক্তি, আগ্নেয়াস্ত্র, রড, চাপাতি আর রামদার ভাষায় রাজনীতির চর্চা হয়েছে নিকট অতীতেও, সেখানে ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর নেতা নির্বাচনে একটি ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটেনি। গতানুগতিক ধারার রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা ছাত্রদলও যে অনেকখানি বদলে গেছে, তা অপেক্ষাকৃত সংযত আচরণ, কোনো রকম সংঘাত, সহিংসতা এবং পেশিশক্তি প্রদর্শনের পথে না হাঁটার মধ্য দিয়ে প্রমাণ দিয়েছে। এজন্য তারা অভিনন্দন পেতে পারে। অনভিজ্ঞতাজনিত কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এত বড় একটি ভোটযজ্ঞ সফলভাবে সম্পন্ন করায় ভিসি ও শিক্ষকরা অভিনন্দন পেতে পারেন।
যদিও ভোটগ্রহণ শেষে ছাত্রদল ও যুবদল বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী সমবেত করে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে শিক্ষকদের সঙ্গে দৃষ্টিকটু বিতর্কে জড়িয়েছে। ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান একপর্যায়ে মেজাজ হারিয়ে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন এবং ‘ডাকসু নির্বাচন শেখ হাসিনার নির্বাচনকেও হার মানিয়েছে’ বলে বেফাঁস মন্তব্য করে বসেন, যা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে জীবনের প্রথম ভোট দিতে পেরে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে নেননি। পরে আবিদের অভিযোগের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে যুবদল সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্নার কণ্ঠেও। তবে ছাত্রদলের প্যানেলে জিএস প্রার্থী তানভীর বারী হামিম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের দেওয়া রায় মেনে নেওয়ার কথা জানিয়ে বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। ঢাবি ছাত্রদল সভাপতি গণেশ ভিসির সামনে টেবিল চাপড়ে যে হুংকার ও ভেংচি দিয়েছেন, তা ছিল রীতিমতো সীমালঙ্ঘন। এসব উত্তাপ-উত্তেজনা সত্ত্বেও ফলাফল ঘোষণার আগে রাতভর দেশবাসীর মধ্যে যে উদ্বেগ-আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা একপর্যায়ে স্তিমিত হওয়ায় শেষটা ভালোই হয়েছে।
অভাবনীয় বিজয়ের পর সাদিক-ফরহাদদের বিজয় উদ্যাপন বা মিছিল না করার সিদ্ধান্তটি সুবিবেচনাপ্রসূত। পরেও তারা বিনয় ও সহিষ্ণু আচরণ অব্যাহত রেখেছেন। রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও জুলাই শহীদদের কবর জিয়ারতের মাধ্যমে যাত্রা শুরু ইতিবাচক। ভোটগ্রহণকালে আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া সাংবাদিকের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোয় সাদিকদের ধন্যবাদ জানাই। তবে শাহবাগে জামায়াত-শিবিরের কতিপয় অতিআবেগী কর্মী ‘তারেক রহমান জানেন নাকি—সাদিক কায়েম ডাকসুর ভিপি’ এ-জাতীয় স্লোগান দিয়ে বিজয়ের মহিমাকে খানিকটা ক্ষুণ্ণ করেছে। এটা উসকানিমূলক।
এছাড়া একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কোনো একটি কক্ষে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আলোচিত আহ্বান ‘প্লিজ আপনারা কেউ কাউকে ছেড়ে যাবেন না’ বক্তব্যকে ট্রল করা হয়েছে, যা দুঃখজনক। ভিডিওটি সঠিক হয়ে থাকলে এ ধরনের অশোভন আচরণের জন্যে জামায়াত সংশ্লিষ্ট কর্মীদের জবাবদিহির মুখোমুখি করা উচিত।
ছাত্রশিবিরের ইতিহাস গড়া ডাকসু বিজয়ের উল্টো পিঠে রয়েছে কঠিন চ্যালেঞ্জ ও দুর্গম পথ। তাদের মনে রাখতে হবে মাত্র এক বছরের মধ্যে ঘোষিত ৩৬ দফা ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে হবে।
রেকর্ড ভোটে ও ব্যবধানে বিজয়ী হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থী যে তাদের বিপরীতে রায় দিয়েছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। চেয়ারের বাইরে থেকে তুষ্ট করা যত সহজ, দায়িত্বে থেকে জনতুষ্টি ততটাই কঠিন। এরই মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রদল নেতা ঘোষণা দিয়েছেন—‘কোথাও ছাত্রশিবিরকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া হবে না।’ বামপন্থি সংগঠনগুলো তো শিবিরের জাতশত্রু। তারাও ছিদ্রান্বেষণে ব্রতী হবে এবং পদে পদে বিপত্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালাবে।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সাদিক কায়েম ডাকসুতে মোট প্রদত্ত ভোটের ৪৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ পেয়েছেন। এটাই তার নেতৃত্বাধীন প্যানেলের সর্বোচ্চ ভোট। মানে হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কিন্তু সাদিক কায়েমের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য প্রার্থীদের পছন্দ করেছেন। জিএস পদে এসএম ফরহাদ পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ৩৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এ পদে শিবিরকে পছন্দ করেননি ৬৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোটার। একইভাবে এজিএস পদে মুহাম্মদ মহিউদ্দিন খান পেয়েছেন ৩৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ভোট। এ পদেও অন্য প্রার্থীদের পছন্দ করেছেন ৬২ দশমিক ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী।
অন্যান্য পদে বিজয়ীদের ক্ষেত্রেও চিত্র এমনটাই। ফলে এক বছরের মধ্যে সাদিক-ফরহাদদের সামনে সমর্থন ব্যক্তকারী শিক্ষার্থীদের আস্থা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ যেমন আছে, তেমনি বৈরী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সৃষ্ট নানা কিছিমের সংকট মোবাবিলা করতে হতে পারে। নির্বাচিত কমিটির মধ্যেই শিবির প্যানেলের বাইরের পাঁচজন রয়েছেন। বছরান্তে ফের যখন ভোটযুদ্ধে নামতে হবে, তখন সাদিক-ফরহাদদের মুখোমুখি হতে পারে শিবির-বহির্ভূত ঐক্যবদ্ধ ছাত্রশক্তি। তেমন আওয়াজ এরই মধ্যে উঠতে শুরু করেছে।
ডাকসুতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিজস্ব ভোটের সংখ্যা কত তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। ভোটের আগে জানা গিয়েছিল, শিবিরের প্যানেল ভোট পাঁচ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু ফলাফলের পর দেখা যাচ্ছে, এ সংখ্যা সাত হাজারের আশেপাশে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদের প্যানেল থেকে নির্বাচিত গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক সানজিদা আক্তার তন্বীর প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের অঙ্কটি এক্ষেত্রে মাপকাঠি হতে পারে। জুলাই আন্দোলনের নির্যাতিত নারী শিক্ষার্থীর প্রতীক হয়ে ওঠা তন্বীর বিপরীতে বেশির ভাগ প্যানেল কোনো প্রার্থী রাখেনি। এ পদে শিবিরের সাজ্জাদ হোসেন খান ৭ হাজার ১৮৯ ভোট পেয়ে তন্বীর কাছে পরাজিত হয়েছেন। তন্বী পেয়েছেন ১১ হাজার ৭৭৮ ভোট। মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়, তন্বীর প্রতিদ্বন্দ্বী সাজ্জাদের ভোটই শিবিরের কোর বা প্যানেল ভোট। এর সমর্থন মেলে অন্যদের ফলাফলেও।
শিবিরের প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সম্পাদকীয় পদের চারজন এবং সদস্য পদে অনেকেরই প্রাপ্ত ভোটের অঙ্ক সাত হাজারের আশেপাশে। এর বেশি ভোট যারা পেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও প্রতিপক্ষ প্রার্থীর দুর্বলতাসহ বিভিন্ন ফ্যাক্টর কাজ করেছে। সাদিক কায়েম ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় নিজের প্যানেল ভোটের দ্বিগুণ পেয়েছেন। অন্য বিজয়ীরা দুই থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত পপুলার ভোট টানতে সক্ষম হয়েছেন। নির্বাচনপূর্ব বিভিন্ন জরিপে ২৫ শতাংশের বেশি ভোটার স্পষ্ট মতামত দিতে অপারগতা জানিয়েছিল। মূলত তাদের বড় অংশ শেষ পর্যন্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে শিবিরের দিকে ঝুঁকেছেন বলে ফলাফল বিশ্লেষণে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
জগন্নাথ হলের ভোট নিয়ে ছাত্রদলের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হয়েছে বলে ভোটের প্যাটার্ন বলছে। সেখানে ভিপি পদে ছাত্রদলের আবিদ আর জিএস পদে বামপন্থি ঐক্যের মেঘমল্লার বসু একচেটিয়ে ভোট পাওয়ায় ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হন। সংখ্যালঘু ছাত্রদের এ হলে সাদিক কায়েম মাত্র ১০টি ভোট পেয়েছেন। সেগুলো উপজাতি শিক্ষার্থীদের বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে ছাত্রশিবির ছাত্রলীগের ভোট পেয়েছে। কিন্তু ছাত্রলীগের ঘাঁটি জগন্নাথ হলের ফলাফল তার এ বক্তব্য সমর্থন করে না, বরং উল্টো চিত্রই জানান দেয়।
ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল জানার পর একটি মলিন চেহারা আমার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে—সেটি হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন ও মজলুম দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার। খালেদা জিয়ার দীর্ঘকালের আপসহীন লড়াই-সংগ্রামের বিশ্বস্ত হাতিয়ার ছাত্রদলের এমন বিপর্যয় দেখার জন্য তিনি কি প্রস্তুত ছিলেন? নানা জটিল ব্যাধিতে কাবু খালেদা জিয়ার প্রতিক্রিয়া জানার কোনো সুযোগ নেই। তবে ধারণা করি, তিনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। বোধ করি কারণও তিনি চিহ্নিত করতে পেরেছেন।
ইমেজ সংকট, আওয়ামী ন্যারেটিভে ভ্রান্ত প্রচারকৌশল, বিলম্বিত ও অগোছালো প্যানেল ঘোষণা এবং সমন্বয়হীনতা ছাত্রদলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে কাল হয়েছে, আগামীতে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবসময়েই সরকারবিরোধী মনোভাবাপন্ন। ডাকসুর ইতিহাসে সুষ্ঠু নির্বাচনে একবার ছাড়া কখনোই সরকার-সমর্থিত প্যানেল জয়ের মুখ দেখেনি। এবারও শিক্ষার্থীরা ধরে নিয়েছে ছয় মাসের মাথায় বিএনপি ক্ষমতায় বসলে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী নিপীড়নের পুরোনো সময় ফিরে আসতে পারে। এমন আতঙ্ক থেকে শিবিরকে নিরাপদ ভেবেছে।
ভরাডুবির আরো কারণ আছে। জামায়াত যেখানে শিবিরের সাবেক সভাপতি ও দলের সিনিয়র নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের নেতৃত্বে এবং সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পারওয়ারের প্রত্যক্ষ তদারকিতে পুরানা পল্টনের মহানগর কার্যালয় থেকে সর্বশক্তি দিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে লড়াই করেছে, সেখানে ছাত্রদলের লড়াইয়ে কোনো পরিকল্পনার ছাপ ছিল না। আদালতে নির্বাচন স্থগিত হওয়ার প্রতিক্রিয়াসহ নানা ইস্যুতে আবিদরা খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার স্বল্পকালীন রাজনীতিতে এবং বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক ও নির্বাচনি লড়াইয়ে কখনো তারা স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বা রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা ন্যারেটিভ সামনে আনাকে প্রশ্রয় দেননি। কেউ এমন প্রবণতা দেখালে দ্রুত হস্তক্ষেপ করে নিবৃত্ত করেছেন। ইসলামোফোবিয়া বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের-বিপক্ষের বিভাজনের চেষ্টাকে সবসময় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলেন খালেদা জিয়া। দলের ভেতরে বামপন্থিদের দাপট বা এজেন্ডা বাস্তবায়নে তিনি কখনো সায় দেননি। তার সুফলও পেয়েছেন। প্রতিটি সুষ্ঠু নির্বাচনে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার তত্ত্বাবধানে আমান, খোকন ও নাজিম উদ্দিন আলমের নেতৃত্বে প্রথম ও শেষবারের মতো ডাকসু জয় করেছিল ছাত্রদল।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্যও খারাপ লাগছে। দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনে থেকে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, দৃঢ় মনোবলে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এবং দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। মুক্ত পরিবেশে যখন ক্ষমতার কাছাকাছি রয়েছেন, তখন ডাকসুর এ বিপর্যয় নিঃসন্দেহে তাকে বড় ধরনের মানসিক চাপে ফেলেছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদেও ভালো ফলাফলের আশা নেই বললেই চলে। জাকসুতে ছাত্রদল শেষ মুহূর্তে বর্জন করেছে। চাকসুতেও বর্জনের কথা ভাবছে বলে শোনা যাচ্ছে। যদিও এ বর্জনে অর্জন কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে খোদ বিএনপি শিবিরেই। ৫ মাস পরের জাতীয় নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব কতটা প্রবল হবে, তা নিয়ে নিশ্চয়ই নতুন করে ভাবতে হচ্ছে তারেক রহমানকে।
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচনের পরিকল্পনা ও কৌশল নতুন করে সাজাতে হবে বিএনপিকে। সমমনাদের সঙ্গে নির্বাচনি মেরূকরণ পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। যাদের সঙ্গী করে নির্বাচনি লড়াই চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তারা এখন বাড়তি সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচনে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ জামায়াত নির্বাচনপূর্ব বিভিন্ন ইস্যুতে আরো শক্ত অবস্থান নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জোরদার করতে পারে।
এরই মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে জামায়াতের গুরুত্ব যে বেড়েছে, তা দিব্যি চোখে পড়ছে। প্রভাবশালী কূটনীতিকরা জামায়াতের সঙ্গে বসছেন নিয়মিত। ভূরাজনীতির প্রভাবশালী খেলোয়াড়রা জামায়াতকে আগের মতো মৌলবাদী শক্তি বলে উপেক্ষা করছে না। ভোট ও জোটের রাজনীতিতে জামায়াত এর সুফল ঘরে তোলার চেষ্টা করবে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অনেক আগেই মাঠে নামিয়েছে জামায়াত। বিএনপি এক্ষেত্রে ডাকসু নির্বাচনের মতোই পিছিয়ে রয়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি। এ দলটি দুর্বল হলে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হবে, স্বরূপে ফেরার সুযোগ পাবে। দেশের স্বার্থে ও গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপিকে শক্তিশালী থাকতে হবে। তবে পরিবর্তিত বাংলাদেশে শুদ্ধ রাজনীতির চর্চায় অভ্যস্ত হতে হবে।
দ্বন্দ্ব-কোন্দল মিটিয়ে আগামী নির্বাচনে ক্লিন ইমেজের জনপ্রিয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা বিএনপির সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সময় খুব বেশি নেই। এ চ্যালেঞ্জ ঠিকঠাকমতো উতরাতে ব্যর্থ হলে নির্বাচনে প্রথম ধাক্কা অপেক্ষা করছে দলটির জন্য। বাস্তবতাবিবর্জিত বক্তব্য-বিশ্লেষণ দিয়ে খেলো না হয়ে ডাকসুসহ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রিয়্যালিটি মেনে নেওয়াই হবে বিএনপির জন্য মঙ্গলজনক। পাশাপাশি শহীদ জিয়ার কালজয়ী আদর্শে নতুন বাংলাদেশের উপযোগী কর্মকৌশল নিয়ে ভোটের মাঠে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা বাঞ্ছনীয়। তা না পারলে জাতীয় নির্বাচনেও কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক