
ডাকসু’র সাম্প্রতিক নির্বাচন কেবল একটি ক্যাম্পাসভিত্তিক আয়োজন নয়; বরং এটি বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন। ছাত্রসমাজের নির্বাচনে যে বৈষম্য, অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে, তা জাতীয় রাজনীতির সংকট, গণতান্ত্রিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের গভীর অসুস্থতার প্রতিচ্ছবি। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি’র জন্য নির্বাচন-পরবর্তী বাস্তবতা একদিকে যেমন হতাশার কারণ, অন্যদিকে তেমনি ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে পুনর্গঠন করার একটি সম্ভাবনাময় সুযোগ।
বিএনপি ও ডাকসু নির্বাচন, একটি বিশ্লেষণ:
শক্তি:
দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঐতিহ্য ও গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগের উত্তরাধিকার।
দমন-পীড়ন ও অবরোধ সত্ত্বেও ত্যাগী কর্মীবাহিনী সক্রিয়ভাবে দলকে টিকিয়ে রেখেছে।
জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, যা বিএনপিকে একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিস্থাপন করার সম্ভাবনা জাগায়।
দুর্বলতা:
সাংগঠনিক দুর্বলতা সুস্পষ্ট, বিশেষ করে ছাত্রদল নির্বাচনে কাক্সিক্ষত শক্তি প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে।
তরুণদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থতা; সুস্পষ্ট ভিশন, কর্মপরিকল্পনা ও সময়োপযোগী বার্তার অভাব।
নেতৃত্ব নির্বাচনে স্বচ্ছতার ঘাটতি, অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতি।
মিডিয়া উইং দুর্বল, আধুনিক গণমাধ্যম কৌশল প্রয়োগে পিছিয়ে থাকা।
সুযোগ:
তরুণ প্রজন্ম বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান করছে- বিএনপি’র জন্য নতুন করে আস্থা অর্জনের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সরাসরি তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান উপস্থাপনের সম্ভাবনা।
জনগণের জীবনের বাস্তব সমস্যার সমাধানকেন্দ্রিক নীতি প্রণয়ন ও উপস্থাপনা করে বিএনপি একটি গ্রহণযোগ্য শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
হুমকি:
ক্ষমতাসীনদের প্রভাব, প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা।
আন্দোলনভিত্তিক রাজনীতির বাইরে বিকল্প কর্মপরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হলে জনগণের আস্থা হারানোর আশঙ্কা।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আর্থিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব নির্বাচনে অস্বচ্ছতা।
আন্তর্জাতিক মহলে দুর্বল উপস্থিতি দলের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
সংগঠন পুনর্গঠন ও বিশেষত মিডিয়া উইং সংস্কারের করণীয়:
১. কেন্দ্রীয় মিডিয়া উইং পুনর্গঠন:
একটি স্বাধীন ও পেশাদার মিডিয়া টিম গঠন করতে হবে, যেখানে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক, সাংবাদিক, গ্রাফিক্স ডিজাইনার ও ডিজিটাল বিশেষজ্ঞ থাকবে।
মিডিয়া উইং শুধু প্রচারণা নয়, বরং তথ্যভিত্তিক গবেষণা, নীতি-সংক্রান্ত বিশ্লেষণ এবং জনগণের জীবনের সমস্যাকে সামনে এনে কনটেন্ট তৈরি করবে।
২. আধুনিক ডিজিটাল কৌশল গ্রহণ:
ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার (এক্স), টিকটকসহ জনপ্রিয় সব ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে সক্রিয় ও সংগঠিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
নিয়মিত লাইভ টকশো, ডকুমেন্টারি ভিডিও, অ্যানিমেটেড গ্রাফিক্স ও শর্ট কনটেন্ট প্রকাশ করতে হবে।
ভুয়া প্রচারণা প্রতিহত করার জন্য একটি কার্যকর ফ্যাক্ট-চেকিং সেল গঠন অপরিহার্য।
৩. স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সক্রিয় উপস্থিতি:
বিদেশি সংবাদমাধ্যম ও থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিএনপি’র অবস্থান শক্তিশালী করা।
জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশনে নিয়মিত অপ-এড, গবেষণাভিত্তিক নিবন্ধ এবং পরিসংখ্যানভিত্তিক তথ্য প্রচার করতে হবে।
৪. প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন:
মিডিয়া উইংয়ের সদস্যদের সাংবাদিকতা, তথ্য বিশ্লেষণ, প্রোপাগান্ডা মোকাবিলা ও ডিজিটাল ক্যাম্পেইন কৌশলে প্রশিক্ষণ প্রদান।
তরুণ, উদ্যমী ও প্রযুক্তি-সচেতন নেতাদের মিডিয়া উইংয়ে অগ্রাধিকার দেয়া।
৫. জনগণকেন্দ্রিক কনটেন্ট প্রোডাকশন:
কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ ও প্রযুক্তি খাতে বিএনপি’র সুস্পষ্ট পরিকল্পনা সহজবোধ্য ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে।
তরুণদের ভাষা ও মনস্তত্ত্ব বিবেচনা করে রাজনৈতিক বার্তা প্রদান করতে হবে।
উপসংহার:
ডাকসু নির্বাচন বিএনপি’র সামনে নতুন বাস্তবতা উন্মোচন করেছে। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নেতৃত্বের ঘাটতি যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি এই নির্বাচন নতুন করে পুনর্গঠন ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার পথও দেখিয়েছে।
বিএনপি যদি তৃণমূল পর্যায় থেকে পুনর্গঠন, স্বচ্ছ নেতৃত্ব নির্বাচন এবং আধুনিক মিডিয়া উইং প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে দলটি কেবল একটি বিরোধী শক্তি হিসেবে নয় বরং আগামী দিনের বিকল্প সরকার হিসেবে জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন এমবিই
লেখক: চেয়ারম্যান, নিউ হোপ গ্লোবাল মানবাধিকার সংগঠক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক। বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য।