Image description

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্ল্যাট উপহার নিয়েছিলেন ১২ আমলা-বিচারক। উপহারের কারণ ‘রাতের ভোটে ভূমিকা’ রাখা।  একেকটি ফ্ল্যাট ২ থেকে চার হাজারেরও বেশি বর্গফুটের।  বিলাসবহুল এসব ফ্ল্যাট এখন সেসব আমলা বিচারকের কাছে যেন গলার কাঁটা। পাওয়া উপহারও তারা বিধিসম্মতভাবে গ্রহণ করেননি বলে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৮ সালে রাতের ভোট খ্যাত নির্বাচনে নেপথ্যের কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন ওই সচিব-বিচারকরা। ওই ভোটে ভূমিকা রাখার পুরস্কার স্বরূপ একটি করে ফ্ল্যাট দেয়া হয় শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে। 

দুদক বলছে, চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে সংস্থাটি ১২ সচিব-বিচারকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে। এতে নাম আসে দুদকেরই সদ্য দুই সাবেক কমিশনারের। অনুসন্ধানের আগেই সংস্থাটির এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের একটি দল অভিযান চালায়। এতে ফ্ল্যাট বরাদ্দে অনিয়মের বিষয়টির সত্যতা পায় অভিযান পরিচালনা করা দলটি। তারপর দুদকের এক সহকারী পরিচালককে টিম লিডার করে আরেক উপ-সহকারী পরিচালকের সমন্বয়ে প্রকাশ্যে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। 

দুদক সূত্রে জানা যায়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ‘গৃহায়ন ধানমণ্ডি (১ম পর্যায়)’ প্রকল্পের আওতায় নীতিমালা ভেঙে উচ্চমূল্যের ফ্ল্যাট বরাদ্দের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্প অনুযায়ী, ধানমণ্ডির ১৩ নম্বর (নতুন ৬/এ) সড়কের ৬৩ নম্বর প্লটে নির্মিত ১৪ তলা ভবনের ১৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ৬০ শতাংশ (১২টি) সরকারি এবং ৪০ শতাংশ (৬টি) বেসরকারি কোটায় বরাদ্দযোগ্য ছিল। ধানমণ্ডি-৬ এর ৬৩ নম্বর প্লটটি মূলত সরকারি খাস জমি, যার বাজারমূল্য অত্যন্ত বেশি। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশে এই জমি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করে সেখানে ১৪তলা ভবন নির্মাণ করা হয়।

ভবনটিতে দু’টি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট ও নিচতলাসহ দুইতলা গাড়ি পার্কিং রয়েছে। এর মধ্যে ডুপ্লেক্স দু’টি বরাদ্দ পান দুদকের সাবেক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান এবং জহরুল হক। বাকি ১০টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ হয় অন্যান্য সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নামে।  দুদক সূত্র জানিয়েছে, অনুসন্ধানের একপর্যায়ে এসে ওই ১২ সচিব-বিচারককে তলব করা হয়েছে। ফ্ল্যাট পাওয়ায় কি কি ধরনের অনিয়ম হয়েছে এ নিয়ে বিস্তারিত তাদের বয়ান রেকর্ড করা হবে বলেও জানিয়েছে সূত্রটি। 

কাকে কখন ডাকা হয়েছে
দুদক জানিয়েছে, ফ্ল্যাট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে দুদকের সাবেক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান, সাবেক কমিশনার জহরুল হক, সাবেক সচিব মো. ইউনুসুর রহমান, সাবেক সচিব এমএ কাদেরকে আগামী ১৭ই সেপ্টেম্বর সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে এসে বক্তব্য দিতে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আইডিআরএ’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম, সাবেক সচিব আকতারী মমতাজ, সাবেক সচিব মো. সিরাজুল হক খানকে আগামী ১৮ই সেপ্টেম্বর তলব করা হয়েছে।
অন্যদিকে সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ, সাবেক সচিব মো. আনিছুর রহমান ও সাবেক সিনিয়র সচিব এসএম গোলাম ফারুককে আগামী ২১শে সেপ্টেম্বর দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য রাখতে বলা হয়েছে।

তলবের বিষয়ে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, সাবেক সচিবসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বক্তব্য প্রদানের জন্য কর্মকর্তা তাদের তলব করেছেন। 

কার ফ্ল্যাট কত বর্গফুট

দুদক জানায়, সাবেক এই আমলাদের উপহার দেয়া ফ্ল্যাটগুলোর আয়তন একেকটির একেক রকম। এর মধ্যে, দুদকের সাবেক কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মো. জহুরুল হকের ফ্ল্যাটের আয়তন ৪১০৫.০৫ বর্গফুট, সাবেক সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমানের ফ্ল্যাটের আয়তন ২৩১৫.৮৩ বর্গফুট, সাবেক সিনিয়র সচিব ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খানের ফ্ল্যাটের আয়তন ৪৩০৮.৬৮ বর্গফুট, সাবেক সচিব এমএ কাদের সরকারের ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯.১৩ বর্গফুট, সাবেক সিনিয়র সচিব এম আসলাম আলমের ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯.১৩ বর্গফুট, সাবেক সচিব আকতারী মমতাজের ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯.১৩ বর্গফুট, সাবেক সচিব মো. সিরাজুল হক খানের ফ্ল্যাটের আয়তন ২৩১৫.৮৩ বর্গফুট, সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদের ফ্ল্যাটের আয়তন ২৩১৫.৮৩ বর্গফুট, সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সাবেক সিনিয়র জেলা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলামের ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯.১৩ বর্গফুট, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদের ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯.১৩ বর্গফুট, সাবেক সিনিয়র সচিব ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের ফ্ল্যাটের আয়তন ২৩১৫.৮৩ বর্গফুট এবং সাবেক সিনিয়র সচিব এসএম গোলাম ফারুকের ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯.১৩ বর্গফুট।

বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত
সরকারি আবাসিক প্রকল্পে সাবেক সচিব, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও সরকারি কর্মকর্তাদের দেয়া মোট ১২টি ফ্ল্যাটের বরাদ্দ বাতিল করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। দুদকের অনুসন্ধানের একপর্যায়ে গত ১৩ই জুলাই এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
‘গৃহায়ন ধানমণ্ডি (১ম পর্যায়)’ প্রকল্পের আওতায় ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার সড়ক নম্বর ১৩ (নতুন ৬/এ), বাড়ি নম্বর ৭১১ (নতুন ৬৩)তে নির্মিত ভবনের বরাদ্দকৃত এসব ফ্ল্যাট বাতিল করা হয় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের গঠিত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন এবং ২৭৪তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে।