
ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে শুক্রবার মধ্যরাতে হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান ঘোষণা দেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সব ধরনের প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি বন্ধ থাকবে। তিনি বলেন, হল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে গত বছরের ১৭ জুলাই হল প্রভোস্টের নেওয়া সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। পাশাপাশি হল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এর আগে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ইস্যুতে গত ফেব্রুয়ারিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। সহিংসতার পরে সেখানেও ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়। প্রশ্ন হলো, ছাত্ররাজনীতি বলতে আসলে কিছু আছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ইস্যুতে ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি এসএম ফরহাদ দাবি করেছেন, ঢাবির হলগুলোয় ছাত্রশিবিরের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। হলে শুধু সেবামূলক কর্মসূচি রয়েছে। (বণিকবার্তা, ১০ আগস্ট ২০২৫)
তার মানে কি এই যে, শিবির একটি সেবামূলক বা দাতব্য প্রতিষ্ঠান? অতীতে দেখা গেছে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে ছাত্রলীগ বিভিন্ন স্থানে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালন করতো। তাতে ছাত্রলীগ কী এটা দাবি করতে পারে যে, তারা একটি স্বেচ্ছাসেবীমূলক সংগঠন? জিয়াউর রহমানের জন্মমৃত্যুবার্ষিকীতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পালন করে ছাত্রদল। তার মানে ছাত্রদল একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন?
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে জামায়াতের যে অবস্থান, তার বিপরীতে গিয়ে ছাত্রশিবিরের পক্ষে বেশি কিছু বলা ও করা সম্ভব নয়। একইভাবে বিএনপির ভাবনা ও আদর্শের বাইরে গিয়ে ছাত্রদলও খুব বেশি কিছু করতে পারে না। তার মানে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ বা শিবির—কেউই তাদের মূল দলের অ্যাজেন্ডা, ভাবনা ও নীতি-আদর্শের বাইরে যেতে পারে না। যদি না পারে তাহলে এটি কী করে ছাত্ররাজনীতি হয়?
আবাসিক হলে সেবামূলক কাজ করে বলে শিবির নেতা যে দাবি করলেন, সেটি অর্ধসত্য। কেননা শিবির রাজনীতিটাই করে। তারা যদি সেবামূলক কাজ করে থাকে, সেটি রাজনীতিরই অংশ। সেবার আড়ালে রাজনীতি অথবা রাজনীতির আড়ালে সেবা। ছাত্রদের রাজনীতি আলাদা কোনো বিষয় নয়। বরং প্রত্যেকটা সংগঠন মূল দলের শাখা হিসেবে কাজ করে। তারা বরাবরই মূল দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, অ্যাজেন্ডা ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে।
আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শের বাইরে গিয়ে ছাত্রলীগের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না। যে কারণে জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন বললেন যে, এই আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট, তখন ছাত্রলীগের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে পড়েন নিজেদের সক্ষমতা জাহির করতে। তখন মূল দলের সাধারণ সম্পাদকের কথা সত্য প্রমাণ করা ছাত্রলীগের ‘দায়িত্ব’ হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে জামায়াতের যে অবস্থান, তার বিপরীতে গিয়ে ছাত্রশিবিরের পক্ষে বেশি কিছু বলা ও করা সম্ভব নয়। একইভাবে বিএনপির ভাবনা ও আদর্শের বাইরে গিয়ে ছাত্রদলও খুব বেশি কিছু করতে পারে না। তার মানে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ বা শিবির—কেউই তাদের মূল দলের অ্যাজেন্ডা, ভাবনা ও নীতি-আদর্শের বাইরে যেতে পারে না। যদি না পারে তাহলে এটি কী করে ছাত্ররাজনীতি হয়?
ছাত্ররাজনীতি মানে ছাত্রদের জন্য ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত রাজনীতি। কিন্তু আমরা যে রাজনীতিকে ছাত্ররাজনীতি বলছি, সেটি মূলত দলীয় রাজনীতির ছাত্র শাখা। তারা মূল দলের ‘লাঠিয়াল’ হিসেবে কাজ করে। যেহেতু ছাত্ররা একটি বিরাট শক্তি এবং তারুণ্যের উন্মাদনার কারণে তারা সাহসী ও বেপরোয়া, ফলে মূল দল সব সময়ই চায় তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোকে দিয়ে প্রথমত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বজায় রাখতে যাতে ওই শক্তিকে ক্যাম্পাসের বাইরেও মূল রাজনীতির প্রয়োজনে কাজে লাগানো যায়।
এটা মনেই করা হয় যে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আধিপত্য বজায় রাখা গেলে জাতীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ। ফলে যখন যে দল সরকারে থাকে, তারা চায় সবগুলো না হোক, অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যে কারণে বিএনপির আমলে ক্যাম্পাসগুলোয় বিএনপির আধিপত্য, আওয়ামী লীগের আমলে ছাত্রলীগের এবং এরশাদের আমলে ছাত্রসমাজের নিয়ন্ত্রণে ছিল ক্যাম্পাসগুলো।
ক্ষমতায় না থাকলেও চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য ছিল। জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পরে স্বভাবতই ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্রলীগের আধিপত্য শেষ হয়ে গেছে। এখন সেখানে ছাত্রদল ও শিবির। অর্থাৎ ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত দলের ছাত্র সংগঠনগুলোই ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সুতরাং এটিকে ছাত্ররাজনীতি বলা কতটা সংগত—তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা ছাত্র ও তরুণরা জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি নামে যে দলটি গঠন করেছেন, তাদের ছাত্র সংগঠনের রাজনীতিকেও ছাত্ররাজনীতি বলার সুযোগ নেই। কেননা এই দলের সাথে যুক্ত সকলেই ছাত্র নন। উপরন্তু এই দলেও প্রবাসী, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের সংগঠন থাকবে।
একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রমিক সংগঠনও যতটা না শ্রমিকের অধিকার নিয়ে সোচ্চার, তার চেয়ে বেশি তারা মূল দলের কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। মূল দলের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে রাজপথে একটি ‘শক্তিশালী বাহিনী’ হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে আন্দোলন চলাকালীন। ফলে আওয়ামী লীগের শ্রমিক লীগ এবং বিএনপির শ্রমিক দলের কাজের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কম। এই সংগঠনগুলোর নামের সঙ্গে শ্রমিক শব্দটি থাকলেও এবং এই সংগঠনে যুক্ত মানুষেরা পেশায় শ্রমিক হলেও তাদের কর্মকাণ্ডকে শ্রমিক আন্দোলন বলার সুযোগ নেই।
বরং কর্মক্ষেত্রে বা কারখানায় কিংবা রাজপথে কিছু শ্রমিক এক হয়ে নির্দলীয় ব্যানারে যদি কোনো দাবি জানান, প্রতিবাদ করেন—যা সরাসরি শ্রমিকের অধিকারের সাথে সম্পর্কিত, সেটিকে শ্রমিক আন্দোলন বলা যায়। কিন্তু শ্রমিকরা যখন শ্রমিক দল বা শ্রমিক লীগের ব্যানারে মূল দলের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে সোচ্চার থাকেন, সেটিকে শ্রমিক রাজনীতি বা শ্রমিক আন্দোলন বলার সুযোগ নেই।
ওলামা দল এবং ওলামা লীগের ক্ষেত্রেও একই কথা। অর্থাৎ ওলামা বা আলেমরা যখন কোনো আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ব্যানারে কোনো কথা বলেন বা আন্দোলন করেন, সেটিও ওই দলের অ্যাজেন্ডা। সুতরাং ওলামা শব্দটি শুনলেই সব সময় ইসলাম মনে করার কোনো কারণ নেই।
ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না থাকলে জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে উঠবে কীভাবে—এটি পুরোনো প্রশ্ন। এর একটি জবাব হতে পারে কার্যকর ছাত্র সংসদ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যদি নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় এবং সেই নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব না থাকে, তাহলে নেতৃত্ব গড়ে উঠতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যখনই ছাত্ররা দলীয় রাজনীতির অংশ বা ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হন, তখন আর সেটি ছাত্ররাজনীতি বা ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সেটি হয়ে যায় কেন্দ্রীয় রাজনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এটিও হয়তো কোনো সমস্যার সৃষ্টি করতো না যদি ছাত্ররা দলীয় আদর্শে বিভাজিত হয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে না পড়তেন। কারণ ছাত্রজীবনে কোনো দলীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়াটা অবৈধ বা বেআইনি নয়। কিন্তু মূল দল যদি ছাত্রদেরকে লাঠিয়াল তথা প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে, তখন ছাত্র পরিচয় ছাপিয়ে তারা হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার। ছাত্রজীবনে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে যাওয়া; হলে সিট বাণিজ্য; রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিতে জোর করা; ভিন্নমত ও আদর্শের শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ কোনো ছাত্রসুলভ আচরণ নয়। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বিতর্কটা সেখানেই।
অর্থাৎ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের যে গৌরবজনক ভূমিকা ও ছাত্র আন্দোলনের যে ঐতিহ্য, তার সঙ্গে বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির তুলনা করা যুক্তিসংগত নয়। বরং ছাত্ররাজনীতির নামে চলা লেজুড়বৃত্তি, অস্ত্রবাজি আর টাকা কামানোর ধান্দাকে ছাত্ররাজনীতি বললে তাতে ছাত্র ও রাজনীতি—দুটিকেই অসম্মান করা হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।