
নিয়াজ মাহমুদ
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। বহুল প্রতীক্ষিত পরিবর্তনের আশায় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। দায়িত্ব গ্রহণের সময় জনগণের সামনে দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ছিল এই সরকারের প্রধান অঙ্গীকারগুলোর অন্যতম। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই জাতির উদ্দেশে ভাষণে ঘোষণা দিয়েছিলেন, "সংস্কার শুরু হবে নিজেদের ঘর থেকেই।" কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ঘরের ঝাড়ু যে এখনো ধুলোতেই আটকে আছে, তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তাহলে "যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ"
সম্পদের হিসাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি
কথার ফুলঝুরি না বাস্তব উদ্যোগ? সরকার গঠনের শুরুতে উপদেষ্টারা বলেছিলেন, প্রতি মাসে তাঁরা নিজেদের ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন। সেই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছিল জনগণ ও নাগরিক সমাজ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, একমাত্র ব্যতিক্রম নাহিদ ইসলাম ছাড়া আর কোনো উপদেষ্টা কিংবা উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সম্পদের বিবরণ জনসম্মুখে আনা হয়নি। এ প্রসঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান সম্প্রতি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে বলেছেন, "সরকার গঠনের পর উপদেষ্টারা স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ অবধি কোনো একটি মন্ত্রণালয়, এমনকি প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর পর্যন্ত, নিজ নিজ সম্পদের হিসাব দাখিল করেনি।" ছায়া সরকারের কথা শোনা যায় বলে উল্লেখ করেন গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, এরাই (সুবিধাবাদী গোষ্ঠী, নীতিহীনেরা) সেই ছায়া সরকার চালায়। যখন উপদেষ্টারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের সম্পদের হিসাব দেওয়া শুরু করবে, তখন এদের মাতবরি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এরা সরকারকে হিসাব দিতে দেয় না। তারা উপদেষ্টাদের বলে, অতীতে কোনো সরকার এ রকম হিসাব দিয়েছে যে আপনারা দেবেন! উপদেষ্টা নিয়োগ ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ সম্প্রতি বেশ কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভূঁইয়া তাঁর বাবার নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স করে দিয়েছেন। যদিও এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করা হয়নি, তবুও সরকারিভাবে এর কোনো ব্যাখ্যা বা ব্যতিক্রম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। এই ধরনের আচরণ শুধু স্বচ্ছতার প্রশ্নেই নয়, বরং সরকারের নৈতিক অবস্থান ও সংস্কারমূলক প্রচেষ্টার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার হবে একটি আদর্শ মডেল প্রশাসন, যা ভবিষ্যৎ সরকারগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে। দায়বদ্ধতা ছাড়া সংস্কার সম্ভব? অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচির আওতায় কিছু সেক্টরে পরিবর্তন আনার চেষ্টা দেখা গেছে। যেমন, আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় পরিবর্তন, শিক্ষা নীতির সংস্কার এবং সরকারি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা। কিন্তু, নিজের ঘরের স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে এই সংস্কার প্রকৃতপক্ষে কতটা টেকসই হবে? যখন নীতি-নির্ধারকরা নিজেরাই স্বচ্ছতা দেখাতে ব্যর্থ হন, তখন তাঁদের নেতৃত্বে পরিচালিত সংস্কার কর্মসূচিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন আস্থা! আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই নির্বাচন যাতে একটি গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়, তার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা জরুরি। কিন্তু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার এই অভাব সেই আস্থায় ভাঙন ধরিয়েছে। জনগণ চায় না আরেকটি ‘আস্থাহীন’ নির্বাচন। তারা চায়, একটি দৃষ্টান্তমূলক শাসনব্যবস্থা, যা ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক ও নৈতিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে। ড. ইউনূস ও তাঁর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু ইতিহাস একদিন জবাব চাইবে—এই সরকার কেবল কথার ঝুড়ি নিয়ে এসেছিল, না কি বাস্তব সংস্কার ও স্বচ্ছতার নজির স্থাপন করেছিল? নিজেদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করে এই সরকারের উপদেষ্টারা এখনো চাইলে নিজেদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেন। আর সময় খুব বেশি নেই।
জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন
অন্তবর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর গত বছর ২৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমাদের সব উপদেষ্টা দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করবেন। এটি সব সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও বাধ্যতামূলক করা হবে। ড. ইউনূস বলেছিলেন, আমাদের সব উপদেষ্টা দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করবেন। এরপর পর্যায়ক্রমে এটি সব সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও নিয়মিত এবং বাধ্যতামূলক করা হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে প্রতিশ্রুত ন্যায়পাল নিয়োগে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হবে।
সর্বশেষ
অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার ‘সীমাহীন দুর্নীতি’র প্রমাণ নিজের কাছে রয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার। অবসরপ্রাপ্ত এই সচিব বলেছেন, এই উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় না, বদলিও হয় না। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এক সেমিনারে এ অভিযোগ করেন আব্দুস সাত্তার। তবে তিনি উপদেষ্টাদের নাম বলেননি। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা বর্তমানে অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি।
তাহলে বাংলাদেশেও "যে যায় লঙ্কায়, সেই রাবণের" ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। প্রবাদ বাক্যটি অন্তবর্তী সরকারের জন্যও প্রযোজ্য।
লেখক: ইউরোপ প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক