
উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থনীতিকে কোন অবস্থায় পেল, তা জানা ছিল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম চ্যালেঞ্জ। এ কারণে প্রধান উপদেষ্টা অর্থনীতির ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব দেন আমাদের। বিগত সরকারের আমলে আর্থিক দুর্নীতি, তছরুপ ও অপচয় হয়েছিল। শ্বেতপত্রে আমরা তার একটি সম্যক ধারণা তুলে ধরেছি। এই দুর্নীতিগুলো কী ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশে সম্ভব হয়েছিল, তাও সেখানে উল্লেখ আছে। বিশেষভাবে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং আমলার সমন্বয়ে একটি ‘চোরতন্ত্র’ তৈরি হয়েছিল, যেটার বিশ্লেষণ শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে এসেছে। স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতি কীভাবে লুটপাটতন্ত্র কায়েম করেছে, তার একটি ‘রেফারেন্স ডকুমেন্ট’ তৈরি করা হয়েছে। আমি মনে করি, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বড় সাফল্য।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। এর লক্ষ্য ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি, টাকার মূল্যমান পতন এবং অর্থনীতির অন্যান্য কিছু সূচকে বিপদগ্রস্ততা থেকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়া। এই জায়গায় সরকার নিঃসন্দেহে বহুলাংশে সফল হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী হয়েছে, যদিও এখনও তা উচ্চ পর্যায়ে। বিনিময় হার স্থিতিশীল। শুধু তাই নয়, টাকার মান যাতে খুব বেশি বেড়ে না যায়, তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডলার কিনছে।
আরেকটি চ্যালেঞ্জের জায়গা ছিল খাদ্য নিরাপত্তা। দেশে আমন ও বোরো ফসল ভালো হয়েছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তার জায়গায় মোটামুটি স্বস্তি রয়েছে। অন্যদিকে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। প্রবাসী আয়ে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জমে থাকা বৈদেশিক ঋণ অনেকাংশেই পরিশোধ করা হয়েছে। এতে করে জ্বালানি আমদানি সহজ হয়েছে। গত এক বছরে বৈদেশিক ঋণ প্রবাহ মোটামুটি অব্যাহত ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদও বেড়েছে। আইএমএফের ঋণের স্থগিত থাকা কিস্তি ছাড় হয়েছে। সরকার যে ধরনের অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল, সেই জায়গায় যাতে ফিরে যেতে না হয় অর্থাৎ সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা টেকসই করতে কাঠামোগত সংস্কারের চ্যালেঞ্জ ছিল। কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে শ্বেতপত্রে আমরা দুটি জায়গায় প্রাধিকার দিয়েছি– ব্যাংকিং ও জ্বালানি খাত। ব্যাংকিং খাতে প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে ফরেনসিক অডিট শুরু হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত পরিস্থিতি কল্পনার চেয়েও মারাত্মক। হঠাৎ করে খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। এর প্রধান কারণ, আগে এসব ঋণ লুকানো ছিল। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও মালিকানার ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু মূল জায়গায় অর্থাৎ পুঁজি পর্যাপ্ততা ও সঞ্চিতির ঘাটতি এবং আস্থার ঘাটতি মোকাবিলায় দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।
ব্যাংক একীভূতকরণ এবং অধিগ্রহণের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি। ফলে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু মূল সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার নানাবিধ উদ্দেশ্য সরকারের পক্ষ থেকে দেখা গেছে যদিও এটা সময়সাপেক্ষ ও জটিল প্রক্রিয়া।
জ্বালানি খাতে বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত সরকারের আমলে প্রতিযোগিতা ছাড়া জ্বালানি কেনার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। তবে জ্বালানি খাতে গ্যাসের প্রবাহের ঘাটতি রয়ে গেছে, যা বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে বিপন্ন করছে। বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস আহরণের প্রস্তাবে বিদেশি কোম্পানির আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। দেশের ভেতরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও সেই অর্থে অগ্রগতি নেই। ব্যাংক ও জ্বালানির বাইরে বহিঃখাতের উন্নতি দৃশ্যমান। বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, যা আগেও উল্লেখ করেছি।
এসব অগ্রগতির বিপরীতে সরকারের আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে। রাজস্ব আদায়ে অগ্রগতি হয়নি। জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় গত অর্থবছরে আরও কমেছে। কর ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। রাজস্ব ব্যয় বিশেষত বেতন-ভাতা, ভর্তুকি এবং ঋণের সুদ পরিশোধ এতটাই বেড়েছে যে, আমরা রাজস্ব আয়-ব্যয় উদ্বৃত্ত উন্নয়ন ব্যয়ে দিতে পারছি না। উন্নয়ন ব্যয়ের পুরোটা ঋণনির্ভর হয়ে গেছে। সরকারের আয় ও ব্যয়ের এই দুর্বলতার মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ আগামীতে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এক্ষেত্রে আরও ঘনিষ্ঠ মনোযোগ দরকার।
মোটা দাগে আমার পর্যালোচনা হলো– এ সরকারের আমলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে স্বস্তি এসেছে, কিন্তু অর্থনীতি এখনও ঘুরে দাঁড়ায়নি। এর জন্য টেকসই সংস্কার দরকার। ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ তখনই দেখতে পাব– যখন মূল্যস্ফীতি এমন এক পর্যায়ে নামবে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার কমাবে। এতে ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহ, পুঁজি পণ্যের আমদানি এবং জ্বালানির বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়বে। তখন আমরা ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দেখব।
গত এক বছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈষম্য হ্রাসের প্রত্যাশা পূরণে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। মনে রাখতে হবে, বৈষম্যবিরোধী চেতনার মধ্য দিয়ে দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে। এই অভ্যুত্থানের ফসল যদি পিছিয়ে পড়া মানুষের উপকারে না আসে, কৃষক যদি ন্যায্য মূল্য না পায় এবং শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধি যদি মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম থেকে যায়, তাহলে খুবই পরিতাপের বিষয় হবে। এছাড়া বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক বিপন্নতা বেড়েছে। মাথায় রাখতে হবে, অর্থনীতিতে যে স্থিতিশীলতার প্রশংসা আমরা করছি, তার মধ্যে একটি কালো প্রচ্ছায়া কিন্তু রয়ে গেছে। এখানে সরকারের মনোযোগ বাড়ানো খুবই জরুরি।
উপসংহারে বলব, অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করেনি, সেহেতু সাফল্য মূল্যায়নের রেফারেন্স মাপকাঠি নেই। এ কারণে বর্তমান সরকার তার অবশিষ্ট সময়ে আর্থসামাজিক সূচকের উন্নতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য কী কী করতে চায়, তা স্বচ্ছভাবে ঘোষণা করলে নির্বাচনী পথরেখা সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। এতে সরকার তার চূড়ান্ত সময়ের মধ্যে কী কী অর্জন করতে চায়, তা চিহ্নিত করা যাবে। এতে করে অর্জনগুলো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করতে এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সহায়ক হবে।
লেখক: সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি এবং আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য