Image description
 

তুমুল গণআন্দোলনের মুখে ষোলো বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের অবসান হয় ৫ আগস্ট মধ্যাহ্নে। আর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব শপথ গ্রহণ করে ৮ আগস্ট রাতে। এই তিন দিনের বেশি সময় কার্যত বাংলাদেশ সরকারবিহীন, অভিভাবকহীন ছিল। চারদিকে মবের রাজত্ব, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, খুন-অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড অবিরত ঘটতে থাকে। জনগণ যেন জিম্মি হয়ে পড়ে অপরাধী ও সুযোগসন্ধানীদের কাছে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য এক ধরনের বন্ধই ছিল। স্বাভাবিক জীবনের জায়গায় হঠাৎই ভয়ের রাজত্বে বসবাস করে সাধারণ মানুষ।

অনেকেই গত বছরের ওই কয়েকদিনের কথা মনে করে কালবেলাকে বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার মুখে আগে কখনো পড়েনি বাংলাদেশ। এমনকি ১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৮১ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও ১৯৯১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকার পতন হলেও এ ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েনি দেশের জনগণ। কিছুটা সংকট সৃষ্টি হলেও তা ছিল সাময়িক। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট মধ্যাহ্নের পূর্বে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের পূর্ব পর্যন্ত ৮০ ঘণ্টারও অধিক সময় দেশে ছিল না কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গণআন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার যে সংঘর্ষ হয়, তাতে দেশের বেশিরভাগ থানায় ভাঙচুর করা হয়, ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। তাতে অনেক পুলিশ সদস্য নিহত হন। ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকার পতনের পর দেশের প্রায় সব থানা পুলিশহীন হয়ে পড়ে। এ সুযোগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। নির্বিচারে চলে হামলা, ভাঙচুর, ডাকাতি, অগ্নিসংযোগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও হয়ে ওঠে সত্য-মিথ্যার মিশেলে গুজবের কারখানা। তবে এসবের মধ্যেও বড় স্বস্তি এলাকায় এলাকায় ডাকাতি প্রতিরোধে রাত জেগে সাধারণ মানুষের পাহারা।

 

ওই সময়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজ পুরোপুরি বন্ধ ছিল। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে ভয়ে আসেননি বেশিরভাগ কর্মকর্তা। যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের চোখেমুখেও ছিল আতঙ্কের ছাপ। সার্বিক পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেশবাসীকে অভয় দিলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি ঘটেনি।

 
 

সরকারের পতনের পরদিনও বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক-বীমাসহ সবকিছুই ছিল বন্ধ। মতিঝিলের ব্যাংকপাড়ায় ছিল না কোনো মানুষের আনাগোনা। চট্টগ্রাম বন্দর ও সমগ্র স্থলবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। অর্থনীতির চাকা একদমই থেমে যায়। দুদিন পর থেকে কিছু কিছু পোশাক কারখানা খুলতে শুরু করলেও নিরাপত্তারহীনতার কারণে বেশিরভাগ ছিল বন্ধ। অনেক সরকারি দলের ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন কারখানা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

 

আইনজ্ঞদের মতে, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল—তেমন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে শেখ মুজিবকে হত্যার পর কয়েক ঘণ্টা পরই নতুন সরকার গঠিত হয়। আবার সামরিক অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাক আহমেদের পতনের পর একই দিন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন। পাল্টা অভ্যুত্থানে ৭ নভেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসীন হন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হলে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার প্রথমে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে সরকারের শূন্য জায়গা পূরণ করেন। একইভাবে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রবল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে এরশাদ সরকারের পতন হলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের হাল ধরেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। সেখানেও কালবিলম্ব হয়নি। এরপর যতই রাষ্ট্রীয় সংকট তৈরি হয়েছে কখনো সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়নি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। তিন দিন কোনো সরকার ছিল না, এমন ঘটনার মাধ্যমে সম্ভবত বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ইতিহাসের খাতায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। সরকারবিহীন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সুযোগে দেশে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ ও ছিনতাইয়ের মাধ্যমে নাগরিক জীবন হুমকিতে পড়ে গিয়েছিল। সরকার না থাকার দরুন সার্বভৌমত্বও চলে যেতে পারত। সংবিধান প্রণয়নকারীদের ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এরকম ঘটনায় করণীয় সম্পর্কে কোনো বিধান থাকে।