
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারিকৃত পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর ২০২৪ সালের ৫ জুন কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়। এই আন্দোলনকে তৎকালীন হাসিনা সরকার প্রতিহত করতে চাইলে ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর সাংবিধানিক সংকট মেটাতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার সূচনা করা হয়। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন ছিল অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের চেতনামুখী এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন। দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই আন্দোলনের চেতনা ও তাৎপর্য রক্ষা করা আবশ্যক।
অগণতান্ত্রিকভাবে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা পতিত স্বৈরাচারী সরকারের কাছ থেকে দেশকে রক্ষা করা অতটা সহজ ছিল না। জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার অক্লান্ত পরিশ্রম, অদম্য সাহসিকতা, অসংখ্য তাজা প্রাণের রক্তের বিনিময়ে এটা সম্ভব হয়েছে। রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছাত্ররা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে রাস্তা-ঘাটে দিনের পর দিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। ক্ষমতার লোভে অন্ধ স্বৈরাচারী সরকার তবু শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির সঙ্গে কোনো আপোস করেনি। বরং ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ছাত্রদের রাজাকারের সন্তান বলে কলুষিত করেছে। এ ঘটনার পর আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই রাতেই মিছিল শুরু হয়, বিভিন্ন স্লোগানে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। পতিত সরকার আন্দোলনকে রুখে দিতে তার পোষা ছাত্রলীগ বাহিনী দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালায়। আওয়ামী লীগের দোসররা আন্দোলনবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়। এরপর পুলিশ বাহিনী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল নিক্ষেপ, এমনকি সরাসরি গুলি শুরু হয়। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। গুলি লাগার মুহূর্তে তিনি দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আপামর জনতা আন্দোলনে যোগ দেয়। শুরু হয় সরকার পতনের আন্দোলন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনের প্রচার-প্রসার বন্ধ করতে সরকার কর্তৃক সারাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীদের ওপর চলতে থাকে খুন, গুম, হত্যা। পুলিশ ছাত্র-জনতাকে সরাসরি গুলি করতে শুরু করে। এ ঘটনায় শিশুসহ অনেক ছাত্র-জনতা শহীদ হন। সরকারি গেজেট অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদের সংখ্যা ৮৩৪। তবে এর বাইরে আরও অনেকে এ আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া গুরুতর আহত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। এরপর শুরুতে ৬ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় সমন্বয়করা একদিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট এ কর্মসূচি ঘোষণা করে। আন্দোলনকে ঘিরে ৫ আগস্ট অন্তত ১০৮ জন সাধারণ নাগরিক ও পুলিশ নিহত হয়। এরপর সেদিনই ছাত্র-জনতার তোপের মুখে পড়ে ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারী হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালায়।
আন্দোলনের পর নতুন বাংলাদেশ সংস্কারের চিত্রটি আমাদের অবাক করে। ছাত্র-জনতা সম্মিলিতভাবে সংস্কার কাজে যোগ দেয়। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার, দেয়ালচিত্র অংকন প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজের দেশকে সবাই কর্তব্যের সঙ্গে সাজিয়ে তোলে। স্বাধীনতার আনন্দে চারদিকে সবাই উচ্ছ্বসিত। সকলে স্বপ্ন দেখে এক বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন নজিরবিহীন ভূমিকা রাখতে থাকে। দীর্ঘদিনের অত্যাচার, বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তবে এতকিছুর পরও কিছু অপশক্তি দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য নানা অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আবার অনেক সময় অযৌক্তিক দাবি নিয়ে রাজনৈতিক দলের ইশারায় আন্দোলন করে কিছু মানুষ দেশের পরিস্থিতি অশান্ত করতে চায়। এদের শনাক্ত করে হোতাদের আইনের আওতায় নিয়ে শাস্তির পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া দেশের নানা জায়গায় খুন, ডাকাতি ও ধর্ষণের বর্বরোচিত ঘটনা ঘটে চলেছে। তবে সেনাবাহিনীর সহায়তায় বর্তমান সরকার বলিষ্ঠভাবে দেশের এসব বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বিগত সরকারের আমলে বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা ও আইনের অপপ্রয়োগের কারণে রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে সাধারণ জনগণকে অনেক হয়রানি করা হয়েছে। বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে অনেককে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া দেশের সম্পদ লুট করে অনেক নেতা এখন পলাতক। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির তথ্যমতে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। জুলাই আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এসব অপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। সেইসঙ্গে নতুন বাংলাদেশে আর যেন এ ধরনের অন্যায়, অবিচার না হয় সে ব্যাপারে জনগণ ও নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে সজাগ থাকতে হবে। দেশের সংবিধানের নতুন গঠনতন্ত্রে সরকারের প্রতিটি কাজে যেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ড অনুযায়ী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক নির্বাচনব্যবস্থা ও সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। জনগণের অভিযোগ ও সুযোগ-সুবিধা সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে এবং এসব ব্যাপারে যথোচিত সিদ্ধান্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করতে হবে। এছাড়া জনগণের মাঝে জুলাই আন্দোলনের চেতনাকে উজ্জীবিত রাখতে সরকারি দিবস পালন, পাঠ্যক্রমে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঠিক ইতিহাস সংযোজন, পত্র-পত্রিকায় এর তাৎপর্য নিয়ে লেখালেখি, আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ প্রভৃতি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
দেশের সাধারণ মানুষ এখন নতুন চেতনায় উজ্জীবিত। আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো, যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ এখন প্রতিবাদ করতে ভয় পায় না। নিজের অধিকার আদায়ে জনগণ এখন অনেকটা সচেষ্ট। দেশের মানুষ এখন দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশে ন্যায্য অধিকার নিয়ে শান্তিতে বাঁচতে চায়। রাজনীতির নামে খুন, গুমের গতানুগতিক ধারার বিরুদ্ধে মানুষ এখন সিদ্ধহস্ত। দেশের তরুণ সমাজ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিরোধী। দেশের মানুষ এখন চায় সুশাসন, সংস্কার ও উন্নয়ন। জুলাই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অনেক বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মানুষ। আন্দোলনের সময় তাদের বক্তব্য ও গ্রাফিতিতে দেশ নিয়ে নানা আশা-আকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। এছাড়া আন্দোলনের সময় শোষিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আক্ষেপ ও আকাক্সক্ষার কথা আমরা শুনেছি। সকলে স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। এর জন্য অন্যায় ও বৈষম্যবিরোধী চেতনাকে সবার মাঝে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সবাইকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেকে সাবধানে থাকতে হবে এবং দেশের যে কোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে একতাবদ্ধ হতে হবে। তাহলে দেশের আনাচে-কানাচে কোনো ধরনের অন্যায়, দুর্নীতি আর প্রশ্রয় পাবে না এবং নতুন করে কোনো স্বৈরাচারী শাসক এদেশে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস পাবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া