
বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট, ২০২৪-এ পদত্যাগ করে পালিয়ে যান। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় শত শত বিক্ষোভকারীর হত্যার ফলে একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল, যা একটি ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লবে বিকশিত হয়েছিল। ভোটের অধিকার হরণ, বাকস্বাধীনতা দমন, জোর-পূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং ভারতের প্রতি অধীনস্থ বিদেশনীতির ওপর জনগণের অসন্তোষের মধ্যেই ছিল এই বিপ্লবের অনিবার্য বীজ।
মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, মিথ্যা অর্থনৈতিক বিবরণ এবং দৃশ্যমান অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে এই বিষয়গুলো ঢেকে রাখার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিপ্লবকে থামানো যায়নি। হাসিনার যুগ কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিপদ এবং জনগণের অসন্তোষ উপেক্ষা করার পরিণতি সম্পর্কে একটি কঠোর শিক্ষা দেয়। নিচের কারণগুলো কর্তৃত্ববাদী শক্তি এবং নৃশংসতার মুখোশ উন্মোচন করে চব্বিশের বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।
১. নির্বাচনি কর্তৃত্ববাদ : ১৬ বছরে বাংলাদেশের মানুষ কোনো নির্বাচনেই ঠিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১৫৩টি আসন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল, যেখানে ভোটার মাত্র ৪০.০৪% ছিল। ২০১৮ সালে হয় নৈশভোট আর ২০২৪ সালের ভোটে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আওয়ামী লীগ। এর আগে প্রতিটি নির্বাচনে ভোট চুরি এবং ভোট ডাকাতির বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ থাকলেও ফ্যাসিস্ট আমলে প্রকাশ্যে চলে নির্বাচনি কর্তৃত্ববাদ, যেখানে নির্বাচন কমিশন ছিল আওয়ামী লীগের হাতের পুতুল।
২. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ : আওয়ামী লীগের সমালোচনা তো দূরে থাক, নিপীড়িত-নির্যাতীত স্বজনহারা মানুষের কান্নার অধিকারও ছিল না আওয়ামী আমলে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে ২১ হাজার ৮৬৭ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৭ হাজার ১০০টি মামলা করা হয়েছে। এই কালো আইনে প্রতি মাসে মামলার হার ছিল ২৪, আর গ্রেপ্তারের হার ছিল গড়ে ২৬।
৩. কিলিং জোন : হাসিনার গত পাঁচ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ কিলিং জোন হিসেবে ১৬,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে; ওই সময় প্রতিদিন গড়ে ৯ জন নিহত হয়েছে।
৪. বল-পূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা : হাসিনার আমলে অন্তত ৬২৩ জন বল-পূর্বক গুমের শিকার হন। ‘ক্রসফায়ার’ এবং পুলিশ হেফাজতে মারা যান ৩ হাজার ৭৪৭ জন। নিহতদের এই বিশাল সংখ্যার ৭২ শতাংশ ক্রসফায়ার নাটকে এবং বাকি ২৮ শতাংশ জীবন হারান পুলিশ হেফাজতে!
৫. ব্যাংক কেলেঙ্কারি : ২৪টি ব্যাংক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। খেলাপি ঋণ ৮ গুণ বেড়ে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা হয়েছে। দেশের আর্থিক ব্যবস্থা থেকে প্রায় ১৭-৩০ বিলিয়ন ডলার চুরি করা হয়েছে।
৬. শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি : হাসিনার বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ ৬০ জনের দ্বারা শেয়ারবাজার কারসাজির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে!
৭. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে লুণ্ঠন : জ্বালানির নামে রাশিয়া এবং জাপান থেকে ১৯ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার নেওয়া হয়েছে! এগুলো পরিশোধ করতে এবং সেই সঙ্গে আদানি চুক্তিসহ ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য বিশাল ব্যয়ের কারণে বিদ্যুতের দাম ১৪ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প থেকে হাসিনা, জয়, টিউলিপসহ হাসিনা পরিবার প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
৮. দুর্নীতি এবং টাকা পাচার : আওয়ামী আমলে কর এড়াতে এবং দেশের বাইরে অর্থ পাচারের জন্য ব্যবসায়ীদের পণ্যের মূল্য ভুল ইনভয়েস করার চর্চা ছিল যত্রতত্র। এই দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের কারণে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার হারায়। গত ১৫ বছরে হিসাব করলে এভাবে অর্থ পাচারের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৪ বিলিয়ন ডলার!
৯. বিদেশি ঋণনির্ভর অতি ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প : ২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল মাত্র ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। হাসিনা আমলে এই ঋণ চার গুণ বেড়ে ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরে বাংলাদেশ যত টাকা বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে, তার ৭৬ ভাগই হাসিনা নিয়েছে তার ১৫ বছরের শাসনামলে!
১০. চরম বৈষম্য : হাসিনা সরকারের উন্নতির ফাঁকাবুলির মধ্যে ধরা পড়ে এক চরম বৈষম্য। সেরা ৫ শতাংশ ধনীর হাতে দেশের মোট আয়ের ৩০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ কুক্ষিগত হয়ে যায় আর সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশের অংশ থাকে মাত্র শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ!
১১. উচ্চ কর্মহীনতা এবং বেকারত্বের হার : সরকারিভাবে দেখানো হয়, দেশে মাত্র ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার (৩ দশমিক ৫১ শতাংশ); কিন্তু অন্যান্য সমীক্ষায় সরকারের মিথ্যাচার এবং ধড়িবাজি ধরা পড়ে। বাস্তবে বেকার ছিল ১ দশমিক ২৮ কোটি। দেখা যায়, ১৫-২৪ বছর বয়সি যুবকদের (৩৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ) কাজ বা পড়াশোনায় নিয়োজিত নয়। ফলে প্রকৃত বেকারত্বের হার দাঁড়ায় ১২ শতাংশে।
১২. চরম শ্রম-শোষণ : বাংলাদেশের ইনফরমাল খাতেই নিযুক্ত রয়েছে ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশ তথাকথিত চাকরিজীবী। ন্যূনতম মজুরি, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, বেতনসহ ছুটি, স্বাস্থ্য বীমা, ইউনিয়ন করার অধিকারসহ শ্রম-অধিকারের কোনো নিশ্চয়তা নেই এদের।
১৩. ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ১০ টাকায় কেনা আলুর দাম হাঁকানো হয় ৭০ টাকা। চিনি, ভোজ্যতেল, পোলট্রি এবং চাল সিন্ডিকেট বাংলাদেশকে দেওয়া সব বৈদেশিক সাহায্যের ৭৬ শতাংশ হাতিয়ে নেয়। চিনির বাজারে পাঁচটি কোম্পানির আধিপত্য, চারটি কোম্পানি ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এবং চারটি কোম্পানি পোলট্রি খাতে নিয়ন্ত্রণ করে।
১৪. ভুয়া পরিসংখ্যান : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BSS) মতে, শহুরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। তবে, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (SANEM) সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, এই মূল্যস্ফীতির হার আসলে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ!
১৫. বন, নদী, পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি : হাসিনা আমলে ১৩২টি ড্রেজিং সাইটে ৭৭টি নদীর ওপর অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলেছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানীর তালিকায় ছিল, যার ফলে সেখানকার মানুষের আয়ু ৬ দশমিক ৮ বছর কমেছে।
১৬. ভারতের প্রতি নতজানু এবং পরাধীন পররাষ্ট্রনীতি : হাসিনা সরকার কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের সমর্থনে ক্ষমতা ধরে রেখেছে, একতরফা ছাড় দিয়েছে ট্রানজিট অ্যাক্সেস, বন্দর ব্যবহার এবং সুন্দরবনের ক্ষতিকারক জ্বালানি প্রকল্প। বিনিময়ে, ভারত জল-বণ্টন চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং আগ্রাসী সীমান্ত নীতি বজায় রাখে। এই ভারসাম্যহীনতা জনসাধারণের অসন্তোষকে উসকে দেয়, কারণ বাংলাদেশ পারস্পরিক সুবিধা ছাড়াই খরচ বহন করে।
ড. মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, নানইয়াং টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটি (NTU), সিঙ্গাপুর