
চব্বিশের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পালাবদলের সূচনা হলেও রাজনৈতিক পরিসরে দেখা দিয়েছে নতুন এক ‘সংকট’। জুলাই আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বা ব্যক্তিরা যুগপৎ ঐক্যে রাজপথে নামলেও হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদের মধ্যকার সমন্বয় ও সংহতি ভেঙে পড়েছে জ্যামিতিকহারে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই সাবেক মিত্ররাই একে অপরের বিরুদ্ধাচারণ করছে। তাদের মধ্যে রিয়েল, ফেইক কিংবা ছদ্মবেশী আইডির মাধ্যমে পাল্টাপাল্টি অপপ্রচার, ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসা রটনা, ট্যাগিং, ট্রলিং, ঘৃণামূলক ভাষ্য এবং ব্যক্তিগত চরিত্রহননের প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার পাশাপাশি ঘরোয়া বিরোধ মেটাতেও বেছে নেওয়া হচ্ছে ডিজিটাল হিংসা ও মনস্তাত্ত্বিক আক্রমণের পথ। অন্যদিকে, ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশ, নতুন সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সাইবার প্রচার ও বিভাজন শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং জুলাইয়ের চেতনাকেন্দ্রিক ঐক্য ও সংস্কারকেও বাধাগ্রস্ত করছে। একইসঙ্গে সমাজে তৈরি করছে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও ভয়ের সংস্কৃতি। এক্ষেত্রে জনগণের সচেতনতা, সরকারের নীতিমালা সংস্কার ও বাস্তবায়ন, মিডিয়ার বস্তুনিষ্ঠতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারগামী হওয়ার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া জরুরি।
তাছাড়া, কোনো দল বা সংগঠনের কোনো ব্যক্তি অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তির সমালোচনার চেয়ে সংশ্লিষ্ট দল বা সংগঠনকে দায়ী করে ব্যাপক অপপ্রচার ও ট্রলিংয়ের সংস্কৃতিও ইদানীং পরিলক্ষিত হচ্ছে। যা এক দলের প্রতি আরেক দলের বিদ্বেষকে আরও বিষিয়ে তুলছে।
এর বাইরে, আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রলীগ নেতাদের উদ্ভাবিত ‘চালাইদেন পদ্ধতি’র অনুসরণ করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো, সাধারণ জনতার তথ্য যাচাই-বাছাই না করে সেই গুজব প্রচারে ভূমিকা রাখা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ছবি-ভিডিও বা আকর্ষণীয় ফেইক ‘ফটোকার্ড’ তৈরি করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতীয় মিডিয়াগুলোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারও রাজনৈতিক বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশের ডিজিটাল পরিসরে এক ধরনের সন্ত্রস্ত, সহিংস ও অসহিষ্ণু পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সুস্থ মত প্রকাশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সাইবার প্রচার ও বিভাজন শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং জুলাইয়ের চেতনাকেন্দ্রিক ঐক্য ও সংস্কারকেও বাধাগ্রস্ত করছে। একইসঙ্গে সমাজে তৈরি করছে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও ভয়ের সংস্কৃতি। এক্ষেত্রে জনগণের সচেতনতা, সরকারের নীতিমালা সংস্কার ও বাস্তবায়ন, মিডিয়ার বস্তুনিষ্ঠতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারগামী হওয়ার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া জরুরি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ ও প্লাটফর্মের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করে দেখা যায়, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ভিন্নমতের ব্যক্তি বা দলকে ঘায়েল করতে একে অপরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ট্যাগিং ও বুলিং করছেন। একইসাথে নানা ন্যারেটিভ বা বয়ান সৃষ্টিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভুল কিংবা অতিরঞ্জিত তথ্য বা ‘সাইবার মবের’ মাধ্যমে যেকেউ যেকোনো সংগঠন বা ব্যক্তির চরিত্রহনন করার চেষ্টা করছেন। শুধু তাই নয়, কারো কারো এজেন্ডাই হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজস্ব ও নির্দিষ্ট লোকবলের মাধ্যমে ফেইক সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ভিন্নমতকে শায়েস্তা করতে ভুল তথ্যের মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো। বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গণেও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘জুলাই পরবর্তীতে আমরা যে ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা ভাবছি, যেখানে চাঁদাবাজি থাকবে না, জনগণের মতামতের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের পলিসি তৈরি হবে, পার্লামেন্টসহ অন্য ইনস্টিটিউশনগুলো বাধাহীনভাবে ফাংশন করবে ইনক্লুডিং নির্বাচন কমিশন। এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে এই ট্যাগিং কালচার বাধার সৃষ্টি করবে।’ মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম, রাজনীতি বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখা যায়, ছাত্রদল ও বিএনপির অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং বাম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে বিভিন্ন সময় ‘জাশি’, ‘রাজাকার’, ‘বট বাহিনী’, ‘গুপ্ত বাহিনী’, ‘গুপ্ত সংগঠন’, ‘আল বটর’, ‘রগ কাটা’, ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’, ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ এবং ‘পাকিস্তানপন্থি’ বলে আখ্যায়িত করছেন। যদিও আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির নেতাকর্মীদেরকে জামায়াতের প্রতি এতটা আগ্রাসী হতে এবং এসব ট্যাগ দিতে দেখা যায়নি— এমনটাই বলছে বিশ্লেষকরা। এছাড়া, শিবিরের নেতাকর্মীদেরকে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ ও ‘গর্ত থেকে উঠে আসা বাহিনী’ এবং ইউনূস সরকারকে ‘ইউসুফ সরকার’ বলে কটাক্ষ করতেও দেখা যাচ্ছে অনেককে।
এসব প্রচারণার জবাবে জামায়াত ও শিবিরের সমর্থকেরা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদেরকে ‘টেম্পুস্ট্যান্ড’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘দখলবাজ’, ‘টেন্ডারবাজ’, ‘খাম্বা’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করছেন। এছাড়া, বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলোকে ইঙ্গিত করে ‘আওয়ামী লীগের সহজাত সংগঠন’ আখ্যা, ‘টেম্পুস্ট্যান্ড অথবা মৃত্যু’ ব্যঙ্গাত্মক স্লোগান, ছাত্রদলের নেতাদেরকে ‘চাচ্চু দল’, ‘আংকেল’, ‘আদুভাই’ ইত্যাদি সম্বোধনের বিষয়টিও পরিলক্ষিত হচ্ছে। দল হিসেবে বিএনপি-ছাত্রদলকে একশব্দ বানিয়ে বলা হচ্ছে ‘বিছা’।
এর বাইরে, বাম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদেরকে ‘শাহবাগী’, ‘নাস্তিক’, ‘ধর্মবিরোধী’, ‘আওয়ামী দোসর’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন এবং ‘তারা গোসল করেন না’ বলে অভিযোগ তুলে তাদেরকে গোসল করার আহ্বান জানিয়ে হেয় করার মত ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) ‘কিংস পার্টি’, ‘জামায়াত-শিবিরের অঙ্গ ও চাইল্ড বা শিশু সংগঠন’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। পাশাপাশি দলটির নেতা নাহিদ, নাসির উদ্দীন পাটওয়ারী এবং ডা. তাসনিম জারাসহ আরও অনেককে নিয়ে কটূক্তি করার মতো ঘটনা ঘটছে। এছাড়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্যান্য সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নারী নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কর্মসূচিতে ছাত্রদলকে উদ্দেশ্য করে শিবিরের ‘কথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কী তোর বাপ-দাদার’; ‘ভিক্ষা লাগলে ভিক্ষা নে, চাঁদাবাজি ছাইড়া দে’ এবং শিবিরকে উদ্দেশ্য করে ছাত্রদলের ‘জামায়াত শিবির রাজাকার, এই মুহুর্তে বাংলা ছাড়’; ‘রক্ত লাগলে রক্ত নে, রগ কাটা ছাইড়া দে, ইত্যাদি সংবলিত স্লোগান শোনা গেছে। এর আগে, গত ২৭ মে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মু্ক্তির রায়ের প্রতিবাদে ঢাবিতে আয়োজিত ছাত্র ইউনিয়নের এক বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ‘ছ তে ছাত্র শিবির, তুই রাজাকার তুই রাজাকার’ স্লোগান দিতে দেখা যায়।
গত ১৪ জুলাই হাসনাত আব্দুল্লাহ নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে লেখেন, ‘বিএনপির কাছে আমার কিছু প্রশ্ন, যদি ভ্যালিড উত্তর দিতে পারেন দিবেন। জামাত-শিবির রাজাকার (মেনে নিলাম) তাহলে গত ২২ বছর জোট গঠন করে ছিলেন কেন? তাহলে জিয়াউর রহমান জামায়াতের রাজাকার নামক কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে দেশে আনছিলেন কেন? খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক বক্তব্যে শাহবাগের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের (যাদের ফাঁসি হয়েছে, কারাদণ্ড হয়েছে) তাদের নির্দোষ বলেছিলেন কেন? যদি তারা সত্যিকারের রাজাকার হয়ে থাকে তাহলে সেটা না বানানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা আপনারা করেছেন, জোটে থাকাকালীন সময়ে, তাহলে এখন মাত্র ১০ মাসের ব্যাবধানে আওয়ামী বয়ান নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন?’
মো. মাসুদ নামে এক ব্যক্তি কিছু নারী অ্যাক্টিভিস্টের ছবি পোস্ট করে কটাক্ষ করে ফেসবুকে লেখেন, ‘শাহবাগী চেনার উপায়: গায়ে গন্ধ, দেখতে অনেক বিশ্রী, কপালে বিশাল বড় একটা টিপ, আবার গায়ে গন্ধ, হাত কাটা ব্লাউজ, চালের বস্তার মতো ব্যাগ থাকবে কাঁদে, গলার কন্ঠ ফাটা বাঁশের মতো, দেখেই মেনে হয় সপ্তাহের পর সপ্তাহ মাসের পর মাস গোসল করে না, ছেলেদের মতো ড্রেস পরে, বিয়ে করতে চায় না, ছেলেদের মতো সমান অধিকার চেয়ে সিগারেট ইত্যাদি খায়।’
টেম্পুস্ট্যান্ড নামে এক ফেসবুক পেজে শিবিরের কয়েকজন সাবেক নেতার ছবি দিয়ে বানানো ভিডিও শেয়ার করে ক্যাপশনে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদেরকে ‘চাচ্চু’ ও ‘টেম্পুস্ট্যান্ড কর্মী’ আখ্যায়িত করে লেখা হয়, ‘আমাদের চাচ্চু পুকিরা কাউন্টার দেয়ার জন্য হন্য হয়ে বয়স্ক এক্স শিবির খুঁজতেছে। তাদের কষ্ট লাঘব করতে টেম্পু স্ট্যান্ডে রাতদিন পরিশ্রম করে যাওয়া পুকিদের জন্য আমাদের এই ছোট্ট উপহার। টেম্পুস্ট্যান্ড কর্মীরা নির্ধিদ্বায় এটি প্রচার করতে পারো।’
গত ১৬ জুলাই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অফিসিয়ার ফেসবুক পেজে জামায়াত-শিবিরকে ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘গুপ্ত’ আখ্যায়িত করতে দেখা যায়। এক পোস্টে লেখা হয়, ‘প্রিয় গুপ্ত সাধারণ শিক্ষার্থী ও কাফেলা আজ জামাত সন্ত্রাস কর্তৃক কক্সবাজারে রহিমুদ্দিন শিকদার নামে এক জুলাই যোদ্ধা নৃশংসভাবে নিহত হয়েছে। সোহাগ হত্যাকান্ডে আপনারা যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন আজকেও আপনারা জামায়াতের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলুন। প্রতিবাদে, রংপুর মেডিকেল কলেজ ছাত্রদল।’
গত ২৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীদের ‘শিশু’ আখ্যা দিয়ে মো. জহির হোসাইন নামে একজন ফেসবুকে লেখেন, ‘কয়েকজন শিশু মিলে একটা দল গঠন করেছে, যদিও এখনো নিবন্ধন পায়নি, এরই-মধ্যে নিজেদেরকে জাতীয় তেনা (নেতাকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে) বলা শুরু-করেছে!’
সম্প্রতি (৪ জুলাই) ‘ফেইক ফেসবুক’ অ্যাকাউন্ট খুলে ইসলামী ছাত্রশিবির ও গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর নির্দেশনা দেওয়ার একটি স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়, যা পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতা তানভীর আহমেদের। স্ক্রিনশটে দেখা যায়, ‘ছাত্রদল পবিপ্রবি অফিসিয়াল’ নামের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শাখা ছাত্রদলের নেতা তানভীর আহমেদ লেখেন, ‘আগামীকালের মধ্যে সবাই একটা ফেইক আইডি খুলবি। তারপর দিনে অন্তত ১০টা পোস্ট করবি। কী পোস্ট করবি সেটা গ্রুপে বলে দিব। সবার আইডির লিংক দিতে হবে।’ ফেক আইডির ব্যবস্থাপনায় একটি আলাদা ‘শ্যাডো গ্রুপ’ খোলা হবে বলেও জানানো হয় ওই বার্তায়। সেখানে সব সদস্যের বিকল্প আইডি সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়ে তানভীর লেখেন, ‘এটা করতেই হবে মাস্ট। সপ্তাহ শেষে রিপোর্ট করব কে কত পোস্ট করেছে, কতটা রিচ পেয়েছে।’এসব আইডি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের সমর্থকদের সঙ্গে ‘মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’ বাড়াতে এবং বিশেষ কিছু ছবি প্রোফাইলে রাখতে বলা হয়েছে। ফেইক অ্যাকাউন্ট খুলে ভিন্নমতকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনার এ বিষয়টি দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
এর আগে গত ২৭ জুন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অভিযোগ করে বলেন, ‘শিবির তাদের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছে ১০টি করে ফেক আইডি খুলে তাদের বিরোধী যেসব ছাত্ররাজনীতি রয়েছে, তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় গালিগালাজ করতে। তারা কি কখনো ইসলামের ধারক বাহক হতে পারে? আমরা আমাদের অবস্থান তাদেরকে জানিয়েছিলাম, আমরা দেখতে চাই ইসলামী ছাত্রশিবির কেন্দ্রীয় সংসদ তাদের বিরুদ্ধে কি অবস্থান নেয়।’
‘রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরকার সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নিয়মতান্ত্রিক চর্চার প্রতিফলন আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। দলগুলোর ভেতরে সেই আগের চর্চাই দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক যে গুণগত পরিবর্তনের আশা আমরা করছি সেই মেসেজটা দলগুলোর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে শক্তভাবে পৌঁছে দিতে হবে। আমার মনে হয়, এই মেসেজটাই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আগের মতোই রাজনৈতিক ব্যবস্থা বহাল থাকছে, দলগুলো জাস্ট নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে।’-মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম, রাজনীতি বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রচার চলে বাঁশের কেল্লা-কাঠের কেল্লা-খাম্বার কেল্লা পেজ থেকে
এদিকে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে 'জামায়াত ও শিবির সমর্থিত' ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছিল ‘বাঁশের কেল্লা’ নামক ফেসবুক পেজ। বিভিন্ন সময়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ ও প্রতিপক্ষের রিপোর্টের কারণে বন্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে পেজটি। কিন্তু এ নামে খোলা হয়েছে অসংখ্য পেজ। যেগুলোর কাজ হল- আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হওয়া বিভিন্ন প্রতিবেদন ও ভিডিওসহ বিভিন্ন তথ্য প্রচার করা। তবে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলসহ বিএনপির সকল অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত বিভিন্ন অন্যায় ও অনিয়মের তথ্য প্রচার করতে তৎপর হতে দেখা যায় প্লাটফর্মটিকে। কখনো কখনো অতিরঞ্জিত তথ্যও প্রচার করে এটি। বাম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদেরকে ‘শাহবাগী’ আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন প্রচারণায় তৎপর হতে দেখা যায় এ প্লাটফর্মকে। ফেসবুকে সক্রিয়তার পাশাপাশি ‘বাঁশের কেল্লা’ নামে একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলও রয়েছে, যেটির প্রায় আড়াই লাখ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। এই চ্যানেলটিই বর্তমানে বেশি সক্রিয়। এর বাইরে, ‘খাম্বার কেল্লা’ ও ‘টেম্পুস্ট্যান্ড’ নামেও দুটি পেজ বিএনপিবিরোধিরা পরিচালনা করেন বলে জানা গেছে। তবে জামায়াত-শিবিরের সমর্থকরাই এগুলো চালান বলেই অনেকের ধারণা।
অন্যদিকে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে খোলা বিএনপি বা এর অঙ্গসংগঠনগুলোর সমর্থকরা ‘কাঠের কেল্লা’ নামে পেজটি পরিচালনা করছেন। তারা এই পেজের মাধ্যমে নিজেদের দলীয় বা সাংগঠনিক বিষয়াবলি প্রচারের পাশাপাশি জামায়াত, শিবির, চরমোনাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিরোধী দল-সংগঠন ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্যাবলি, হাস্যরসাত্মক ও ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট বা মিম প্রচার করে বিরোধীদের ঘায়েল করা চেষ্টা করেন। বিশেষ করে, এই পেজটির নাম ও কার্যক্রম দেখে ধারণা করা যায়, জামায়াত-শিবির সমর্থিত প্লাটফর্ম ‘বাঁশের কেল্লা’কে টেক্কা দেওয়া এটির অন্যতম উদ্দেশ্য। এছাড়া, ইদানীং লোহারকেল্লা নামেও একই কর্মসূচিভিত্তিক একটি পেজের কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে।
গত ২৩ জুলাই বুধবার ‘কাঠের কেল্লা’ পেজটির এক পোস্টে লেখা হয়, ‘ফজু পীর, শফিক কিন্তু চালাক আছে। পিআর চালু করে ৫/৬ লাখ টাকা দিয়ে নমিনেশন বিক্রি না করে ৫০/৬০ কোটি দিয়ে রেডিমেড এমপি বিক্রি করবে।’ এর আগে গত ১৮ জুলাই এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলামকে ব্যঙ্গ করে এ পেজে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, নাহিদের ব্যঙ্গাত্মক একটি ছবি সংবলিত ফটোকার্ডে তার উদ্ধৃতি হিসেবে একটা লেখা যুক্ত করা হয়েছে। লেখাটি ছিল এমন- ‘কেউ আর্মির ট্যাংকে উঠতে দেখেছেন আমাকে? অবশ্যই, দেখেন নাই। কারণ, আমি আমার ভুঁড়ি ব্যাংকের টাকা ভুড়িতে স্টক করতে করতে অনেক ফুলে গিয়েছিলো পেট। পরের বার অবশ্যই চেষ্টা করবো যাতে আর্মির ট্যাংকে ঢুকতে পারি। চিন্তার কারণ নেই নির্বাচন পিছিয়ে দিতে ওয়কারকে হাসনাত বলেছে ট্যাংকের ভেতরে।’
গত ৯ জুলাই রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯)। এ ঘটনায় যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার কথা উঠে আসার পর সারাদেশব্যাপী বিএনপিবিরোধী অর্থাৎ ভিন্নমতের ব্যক্তিরাসহ অনেকেই বিএনপি দলটির বিরুদ্ধেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। অন্যদিকে, দেশের কোথাও কোনো জামায়াতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অপরাধে জড়ালে তার সমালোচনার পরিবর্তে জামায়াতের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রচলন দেখা যাচ্ছে। একই সংস্কৃতি অন্যদের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে।
গত ১৯ জুলাই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জাতীয় সমাবেশে সভাপতির বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে যান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তার এই অসুস্থ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেককে ‘নাটক’ বা ‘অভিনয়’ অভিহিত করে ব্যঙ্গাত্মক প্রচারণা করতে দেখা গেছে।
বিএনপি-ছাত্রদল, জামায়াত-শিবির, বাম, এনসিপি ও অন্যদের রেষারেষির মধ্যেই নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর বিভিন্ন নেতাকর্মীদের দেশকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন গুজব, প্রোপাগান্ডা ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর বিষয়টি বারবার সামনে আসছে। এছাড়া, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অফিসিয়াল পেজ কিংবা নেতাকর্মীদের নিজস্ব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেও বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা এবং মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্যের মাধ্যমে সাধারণ জনতাকে বিভ্রান্ত করতে দেখা যাচ্ছে।
চলতি মাসে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও মাইলস্টোন কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় বিভিন্ন পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ছবি আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট প্লাটফর্মগুলোর মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেস উইং থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মোহাম্মদ এ আরাফাতসহ দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ঘাঁটাঘাঁটি করলে এসব অভিযোগের সত্যতাও মেলে।
এ বিষয়ে মতামত জানতে কথা হয় রাজনীতি বিশ্লেষক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, জুলাই পরবর্তী সময়ে যেখানে বড় ধরনের ঐক্যের দরকার ছিল সেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভাজন, বিরোধ বা মতানৈক্য দেখা যাচ্ছে, যা খুবই হতাশাজনক। এই বিভাজন যখন তৈরি হয় তখন একে অপরের বিরুদ্ধে থাকা ইস্যুগুলো সামনে আনার চেষ্টা করে। জুলাইয়ের চেতনাকে ধারণ করে ঐক্য ঠিক রাখা এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতায় কারা যাবে, এই দুটি বিষয়টি বিবেচ্য। ক্ষমতার চাহিদাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মোর্চা গঠনের আভাস পাচ্ছি। পাশাপাশি, সভা-সেমিনার কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় একে অপরের বিরুদ্ধে ট্যাগিং কালচার দেখতে পাচ্ছি, যা অপ্রত্যাশিত। এ কালচারের চর্চা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে চলছে। এ কারণে জুলাইয়ের চেতনাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ঐক্য বাধাগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, জুলাই পরবর্তীতে আমরা যে ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা ভাবছি, যেখানে চাঁদাবাজি থাকবে না, জনগণের মতামতের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের পলিসি তৈরি হবে, পার্লামেন্টসহ অন্য ইনস্টিটিউশনগুলো বাধাহীনভাবে ফাংশন করবে ইনক্লুডিং নির্বাচন কমিশন। এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে এই ট্যাগিং কালচার বাধার সৃষ্টি করবে।
সমস্যা সমাধানে জনগণ, সরকার ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার প্রসঙ্গে এ শিক্ষাবিদ বলেন, সঠিক তথ্য আমাদের কাছে আসছে নাকি ভুল তথ্য, তা গ্রহণের ক্ষেত্রে সাধারণ জনতার মাঝে যাচাই-বাছাইয়ের চর্চা বা অ্যাভয়ডেন্স ডেভেলপ করা দরকার। তবে এটাও বাস্তব যে, ডিজিটাল যুগে কোনো কোনো তথ্য সবার পক্ষে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়ে উঠে না। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এখন অনেক অবাস্তবকেও বাস্তবের মত করে তুলে ধরা যায়। এক্ষেত্রে মূলধারার প্রত্যেকটা সংবাদমাধ্যমকে ভুল ও সঠিক তথ্যের পার্থক্য নিরূপণ করার ক্যাপাসিটি ও সিস্টেম ডেভেলপ করা এবং তা বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে গুজব ছড়ানো ও ট্যাগিং কালচার সামনে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় নীতিমালাও ঢেলে সাজাতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের ব্যাপারে অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর আমরা বিভিন্ন সংস্কার বা পরিবর্তনের কথাই বলছি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরকার সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নিয়মতান্ত্রিক চর্চার প্রতিফলন আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। দলগুলোর ভেতরে সেই আগের চর্চাই দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক যে গুণগত পরিবর্তনের আশা আমরা করছি, সেই মেসেজটা দলগুলোর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে শক্তভাবে পৌঁছে দিতে হবে। আমার মনে হয়, এই মেসেজটাই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আগের মতোই রাজনৈতিক ব্যবস্থা বহাল থাকছে, দলগুলো জাস্ট নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে।