Image description
আলফাজ আনাম
 

বাংলাদেশে বিমান বাহিনী আকারে কোনো বড় বাহিনী নয়। কিন্তু দুর্ঘটনার সংখ্যা একেবারেই কম নয়। ২০০৮ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, অন্তত ১১টি প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। এতে অধিকাংশ পাইলট মারা গেছেন। এর আগে প্রশিক্ষণ বিমানগুলো জনমানবহীন এলাকায় বিধ্বস্ত হওয়ায় বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এবার বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার বিষয়টিকে নিছক একটি দুর্ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এই দুর্ঘটনায় অকালে মারা গেল অন্তত ত্রিশ জনের মতো শিশু। এই বেদনা সহ্য করার মতো নয়। যে শিশুরা মারা গেল এরা ছিল দেশের ভবিষ্যৎ, এমনকি এদের মধ্য থেকে হয়তো অনেকে হতে পারতেন দক্ষ পাইলট।

সবচেয়ে বেশি যুদ্ধবিমান যেসব দেশে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তার পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে—যেসব দেশের বড় আকারের বিমানবাহিনী আছে, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও অভিযান চালানো হয়, পুরোনো প্রযুক্তি বা রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা এবং যুদ্ধ বা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সক্রিয় থাকা।

বিশ্বের বহু দেশে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সংখ্যা কম নয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বছরে গড়ে শতাধিক সামরিক বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে। কিন্তু প্রতি মিশন অনুযায়ী তাদের হার তুলনামূলকভাবে কম, কারণ বিমানের সংখ্যা ও মিশন বেশি।

অপরদিকে রাশিয়া ও ভারতীয় বিমানবাহিনীতে প্রতি হাজার ঘণ্টায় দুর্ঘটনার হার বেশি। ভারতে প্রশিক্ষণ বিমান ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিগ-২১ বেশি ব্যবহার করা হয়। ভারতে বিমান বাহিনীর দুর্ঘটনার জন্য এই বিমানটিকে দায়ী করা হয়। ভারতীয় বিমান বাহিনীর বহরে বিপুলসংখ্যক মিগ-২১ থাকার কারণে এখনো সেক্ষেত্রে নতুন যুদ্ধবিমান পুনঃস্থাপন করা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি।

মিশন পরিচালনার দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বাংলাদেশে সামরিক দুর্ঘটনার সংখ্যা কোনোভাবেই কম বলা যাবে না। বিমান দুর্ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া পাইলটের সংখ্যা খুব কম। মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত হওয়া এই বিমানের দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে এখন নানা আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে আলোচনায় এসেছে চীনের তৈরি এই প্রশিক্ষণ বিমানের নানা দিক।

এই প্রশিক্ষণ বিমান তৈরি করে চীনের চেংডু এয়ারক্রাফট করপোরেশন। চীনে অভ্যন্তরীণভাবে এই বিমানটি ব্যবহার করা হয়। এটি জে-৭ নামে পরিচিত। রপ্তানির সময় এর নামকরণ হয় এফ-৭। এয়ারফোর্স টেকনোলজি ডটকম নামে একটি ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, জে-৭-এর নকশার ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে সোভিয়েত আমলে তৈরি মিগ-২১ যুদ্ধবিমানকে। আসলে এই প্রশিক্ষণ বিমাটি মূলত মিগ-২১-এর চীনা ভারশন।

চীনের কাছে অনেক উন্নত মানের যুদ্ধবিমান আছে। এর মধ্যে চীনের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান নিয়ে দুনিয়াজুড়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যে সম্প্রতি পাক-ভারত যুদ্ধে চীনের তৈরি জে-১০ সি যুদ্ধবিমান ফ্রান্সের রাফাল যুদ্ধবিমানকে ধরাশায়ী করে চমক দেখিয়েছে। কিন্তু চীনের পুরোনো আমলের জে-৭ যুদ্ধবিমানের দুর্ঘটনার অনেক নজির আছে।

১৯৬২ সালের ৩০ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যে মিগ-২১-এর প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তি হয়। এই লাইসেন্সের আওতায় চীন এই সামরিক বিমানগুলো বানায়। ফলে এই বিমানগুলোয় মিগ-২১-এর নকশার প্রতিফলন আছে।

রপ্তানির সময় চীনা কোম্পানিটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান আমদানিকারকের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করে। তবে এ ধরনের জেট সারা বিশ্বেই আকাশ প্রতিরক্ষা, বহুমুখী অভিযান ও পাইলটদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান ও ইরান এই প্রশিক্ষণ বিমান ব্যবহার করে থাকে। সেখানেও দুর্ঘটনার রেকর্ড আছে। নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের চেয়ে এই প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনার হার বেশি। এর কারণ পুরোনো নকশার এয়ারফ্রেম, সীমিত নিরাপত্তা ও আধুনিক ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাব।

প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় পাইলট ও এতগুলো শিশুর প্রাণহানির পর বিমান বাহিনীর দুর্বলতার দুটি বিষয় সামনে এসেছে। প্রথমত, প্রশিক্ষণ বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন রাজধানীর মতো জনবহুল এলাকা বেছে নেওয়া হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশিক্ষণের সময় বিমান দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। ঢাকার মতো জনবহুল এলাকায় এ ধরনের ঘটনা কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। এছাড়া দীর্ঘদিন থেকে বেসামরিক বিমান চলাচলের জন্য ব্যবহৃত রানওয়ে প্রশিক্ষণ বিমানের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যা নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি। অথচ এসব বিষয়ে শুধু সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ নয়, বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে আপত্তি আসা উচিত ছিল।

দ্বিতীয় প্রশ্ন এসেছে, আসলে আমাদের বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন কতটা হয়েছে? বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে দেখা যাচ্ছে, চীনের তৈরি এই বিমানগুলো বাংলাদেশ বুঝে নিয়েছিল ২০১৩ সালে। এ সময় বাংলাদেশ ১৬টি বিমান কেনে। খোদ চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি ২০২৩ সাল থেকে এই যুদ্ধবিমানগুলো আর ব্যবহার করছে না। চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কাছে জে-১০ যুদ্ধবিমান বিক্রির আগ্রহের কথা আমরা বিভিন্ন সময় শুনেছি। এমনকি পাকিস্তান ও চীনের যৌথভাবে তৈরি জে-১৭ যুদ্ধবিমান বিক্রির বিষয় বিভিন্ন সময় খবরে এসেছে। কিন্তু আমরা সেদিকে এগোতে পারিনি; বরং পুরোনো আমলের জে-৭ দিয়ে আমাদের বিমানবহর চলছে।

শেখ হাসিনার দেড় দশকের মাফিয়া শাসনে সামরিক খাতে কেনাকাটা দুর্নীতির বড় একটি উৎস হিসেবে পরিচিত, যা শুরু হয়েছিল শেখ হাসিনার প্রথম দফার শাসনামল থেকে। সে সময় বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান কিনেছিল। এসব যুদ্ধবিমান এখন অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। এগুলো কেনা হয়েছিল দুর্নীতির জন্য প্রতিরক্ষা শোপিস হিসেবে।

হাসিনার শাসনামলে এমন সব সমরাস্ত্র কেনা হয়েছে, যা আমাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা তো বাড়ায়নি, বরং এগুলো আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন থেকে কেনা জে-৭ এখন বাংলাদেশের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

বাস্তবতা হচ্ছে শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবকাঠামো নির্মাণসহ বেতনভাতা ও সুযোগ-‍সুবিধার দিকে যতটা মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, ততটা মনোযোগ দেওয়া হয়নি সামরিক সরঞ্জাম কেনার দিকে। অনেকে মনে করেন, ভারতের বাধার কারণে আধুনিক যুদ্ধবিমান তো দূরে থাক, প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য কোনো আধুনিক সরঞ্জাম কেনা সম্ভব হয়নি। উল্টো ভারতের ব্যর্থ তেজাস যুদ্ধবিমান কেনার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালানো হয়েছে।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ডামি নির্বাচনের পর ফেব্রুয়ারি মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ নয়াদিল্লি সফর করেন। বিজেপির থিংক ট্যাংক বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশনে এক সেমিনারে হাছান মাহমুদ জানান, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা রয়েছে। ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম বাংলাদেশ কেনে। আগামী দিনেও কিনবে। ভারতের তৈরি হালকা সামরিক বিমান ‘তেজস’, ‘ধ্রুব’ হেলিকপ্টারসহ বেশ কিছু সামরিক সম্ভার পেতে বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশে রাশিয়ার তৈরি ‘এমআই ১৭’ বহরের রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রেও ভারত আগ্রহ দেখিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিস্তারে কতটা অগ্রগতি হয়েছে—সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে হাছান মাহমুদ ওই উত্তর দেন। (প্রথম আলো, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

আমরা যেন ভুলে না যাই, তারিক সিদ্দিকের মতো একজন দুর্বৃত্ত জেনারেল দেড় দশক ধরে প্রতিরক্ষা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করেছেন, যিনি সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের নামে গুম-খুনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল আয়নাঘর। শুধু সেনাবাহিনীর ভেতরে কেনাকাটার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকা নয়, জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে এই গোঁফওয়ালা জেনারেলের বিরুদ্ধে। বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ ‍থাকা রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক ও বেসামরিক যেসব চুক্তি হয়েছে, সেসব চুক্তির সময় হাসিনার সঙ্গে সবসময় তিনি ছায়াসঙ্গী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। মিয়ানমারের মতো দেশের কাছে যে ধরনের যুদ্ধবিমান আছে, আমাদের বহরে সে ধরনের কোনো যুদ্ধবিমান নেই। শুধু অর্থনৈতিক সামর্থ্যের অভাবে আমরা তা পারি না, এমন নয়—দুর্নীতি ও প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বড় প্রভাবক হিসেবে এক্ষেত্রে কাজ করছে বলে মনে করা হয়।

 

বিমান দুর্ঘটনার এই বিয়োগান্ত ঘটনাকে আমরা শুধু একটি দুর্ঘটনা হিসেবে দেখতে চাই না। আমরা চাই না রাষ্ট্রের বিপুল অর্থে প্রশিক্ষণ নেওয়া পাইলটরা উড়ন্ত কফিনে তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিক। শহীদ শিশুদের রক্তের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হবে, যদি আমরা শক্তিশালী একটি বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে পারি—যে বাহিনীতে থাকবে না বিধবা বানানোর মেশিনের মতো লক্কড়ঝক্কড় মার্কা কোনো যুদ্ধবিমান, যেখান থেকে গড়ে উঠবে সাইফুল আজমের মতো গর্বিত পাইলট।