
চব্বিশের ১৬ জুলাই থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার সমর্থকদের সঙ্গে কোটা আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতায় শত শত মানুষ হতাহতের পরও ২৬ জুলাই পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহতের দেখতে যাননি।
এ নিয়ে সমালোচনার ভেতর ২৭ জুলাই শনিবার হাসিনা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় আহতদের দেখতে ঢাকার আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশনে যান; যা পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত।
সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়ে বাংলাদেশকে আবার ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করতেই কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা চালানো হয়েছে।
সংঘাতে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির দায়দায়িত্ব কার—এমন প্রশ্নও রাখেন হাসিনা। বলেন, 'কোটা তো আমি বাতিলই করে দিয়েছি। আমি আহ্বান করেছিলাম একটু ধৈর্য ধরো। হাই কোর্টে শুনানি হবে। না, তারপরেও এই আন্দোলন, আজকে এতগুলো মানুষের জীবনের ক্ষতি হলো, এতগুলো পরিবারের ক্ষতি হলো। এর দায় দায়িত্ব কাদের?'
নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা 'অশ্রুসজল-আবেগাপ্লুত' শেখ হাসিনা সেদিন এও বলেন, 'আর এভাবে মায়ের কোল খালি হোক এটা আমি চাই না। কারণ আমি তো বাবা-মা সব হারিয়েছি, আমি তো জানি হারাবার ব্যথা কত কষ্টের।'
অথচ অভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের পর চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, সেদিন পঙ্গু হাসপাতালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের দেখতে গিয়ে চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে 'নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ' নির্দেশ দিয়েছিলেন হাসিনা।
ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করেন তাজুল ইসলাম। বলেন, 'তখন সেখানে ভর্তি থাকা রোগীরা-আহতরা জানান, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগে একবার হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন—নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ। অর্থাৎ কোনো চিকিৎসা দেওয়া যাবে না, কাউকে এখান থেকে বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না।'
শেখ হাসিনার এমন নির্দেশের কথা সেখানকার চিকিৎসকরাও জানিয়েছেন উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম আরও বলেন, 'এ–সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণাদি আমাদের কাছে আছে।'
এছাড়া সম্প্রতি বিবিসি, দ্য ডেইলি স্টার ও আলজাজিরার একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, আন্দোলন দমাতে বিক্ষোভকারীদের ওপর সরাসরি গুলি ও প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারের নির্দেশ স্বয়ং হাসিনাই দিয়েছিলেন।
২৭ জুলাই শেখ হাসিনা পঙ্গু হাসপাতালের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও টোল প্লাজাও পরিদর্শন করেন। দেশজুড়ে চলতে থাকে ব্যাপক ধড়পাকড়।
ওই দিন পর্যন্ত ১১ দিনে সারা দেশে মোট ৯ হাজার ১২১ জনের গ্রেপ্তারের খবর আসে। কেবল রাজধানী থেকেই গ্রেপ্তার করা হয় ২ হাজার ৫৩৬ জনকে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজন মারা যান। সবমিলিয়ে সেদিন পর্যন্ত সংঘাতে নিহত দুইশ ছাড়িয়ে যায়। ঢাকার ১১ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়।
গত বছরের ২৭ জুলাই ক্ষতিগ্রস্ত টোলপ্লাজা দেখতে যান শেখ হাসিনা। ছবি: পিআইডি
হাসনাত ও সারজিসও ডিবি হেফাজতে
২৭ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
তারা হলেন সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। ডিবি জানায় এই দুজনকেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দিতে ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে তথ্য জানতে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
এর আগের দিন শুক্রবার বিকেলে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকেও তুলে নেয় ডিবি।
তবে 'হেফাজতে থাকা' এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে তখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে জানায় গোয়েন্দা পুলিশ।
এ নিয়ে আটককৃতদের পরিবারের সদস্যরা বলেন—মামলা ছাড়া কেন তাদের তুলে নেয়া হয়েছে, কেন আটকে রাখা হয়েছে, সেটি জানতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ক্রমাগত যোগাযোগের চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়েছেন।
২৭ জুলাই রাতে অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে আসেন বাইরে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক।
সংবাদ সম্মেলনে তারা জানান, পুলিশের ধরপাকড়সহ নানা কারণে সব সমন্বয়কদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না। যে কারণে সমন্বিতভাবে কোন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারছেন না তারা।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, 'আন্দোলনের মূল দাবি মেনে নেয়া হয়েছে বলে প্রচার করছে সরকার। কিন্তু আমাদের দাবি ছিল কমিশন গঠন করে এই সংকটের সমাধান করা। কিন্তু সেটি করা হয়নি বলেই আমরা এই পরিপত্র প্রত্যাখ্যান করছি।'
আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, 'রোববারের মধ্যে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ, আসিফ মাহমুদসহ আটক সকল শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও শিক্ষার্থী গণহত্যার সাথে জড়িত মন্ত্রী পর্যায় থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সকল দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।'
পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই দাবিগুলো মানা না হলে সোমবার থেকে আরও কঠিন কর্মসূচি দেওয়ার হুমকিও দেন হান্নান মাসুদ।
এর পাশাপাশি ওই সংবাদ সম্মেলন থেকে ২৮ জুলাই রোববার সারাদেশের দেয়ালগুলোতে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন কর্মসূচির ঘোষণাও দেওয়া হয়।
নুরকে নির্যাতনের অভিযোগ
২৭ জুলাই বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেন ডাকসুর সাবেক ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের স্ত্রী মারিয়া আক্তার।
এর আগে ২০ জুলাই ভোররাতে হাতিরঝিলের বাসার দরজা ভেঙে নুরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়। পরে ডিবি, র্যাব কার্যালয় ও হাতিরঝিল থানায় খোঁজ নিলে তারা কোনো তথ্য দেয়নি নুরের পরিবারকে।
তবে ২৫ জুলাই নুরকে যখন আদালতে তোলা হয় তখনকার কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায় পুলিশের কাঁধে ভর করে আদালতে হেঁটে আসেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে নুরের স্ত্রী মারিয়া বলেন, 'যেদিন তাকে (নুরকে) কোর্টে তোলা হল সেদিন গিয়ে যা দেখলাম তা কোনো মানুষ সহ্য করতে পারবে না। গ্রেপ্তারের পর থেকে তার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। এমন নির্যাতন করা হয়েছে যে নুর নিজের পায়ে হেঁটে আদালতে আসতে পারেনি।'
এ সময় নুরের চিকিৎসার দাবি জানিয়ে মারিয়া আরও বলেন, 'আমার অনুরোধ সন্তানের জীবন থেকে বাবার স্নেহ যেন কেড়ে নেওয়া না হয়। আমি দাবি জানাই নুরকে আর যেন রিমান্ড নেওয়া না হয়। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা যেন করা হয়।'
আক্রমণকারীদের প্রধান আক্রোশই ছিল পুলিশ এবং আ. লীগের প্রতি: সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
এদি কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে নারায়ণগঞ্জে যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন শেষে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন তিনি।
সাবেক এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, একটি মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, 'আক্রমণকারীদের প্রধান আক্রোশই ছিল পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের প্রতি। আমাদের র্যাব, পুলিশ, বিজিবি যখন একত্রে পারছিল না তখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছি। খুব শিগগিরই আমরা এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবো।'