Image description

মোহাম্মদ আসাফ্উদ্দৌলাহ্

শাহ্ আবদুল হান্নানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় যখন বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সুপারিশে আমাদের অর্থনীতিতে সর্বপ্রথম ভ্যাট অর্থাৎ ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্সের প্রবর্তন করে। ভ্যাটের মাধ্যমেই দেশের সব ভোক্তাকে কর দেয়ার বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে আসা হয় এবং এর মাধ্যমেই আমাদের অর্থনীতিতে ঘটে বিরাট বিপ্লব। ভ্যাট ছাড়া আজকের বাজেট প্রণয়ন প্রায় অসম্ভব।

হান্নান ভাই তখন এনবিআরের ভ্যাটের সদস্য। যে উদ্দীপনা ও উৎসাহ নিয়ে তিনি প্রতিটি মন্ত্রণালয়, পরিদফতর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিজে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গিয়ে ভ্যাটের কারণ ও তার আদ্যোপান্ত ব্যাখ্যা করেছিলেন তা ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত। এ কথা মোটামুটি বলা যায়, তার এই প্রচণ্ড উদ্যম ছাড়া দেশে ভ্যাট চালু করা সহজ হতো না। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের নামে ভ্যাটের কৃতিত্ব দেয়া হয়। কিন্তু মূল সব কাজই শাহ্ আবদুল হান্নান করেছিলেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রায় ২০০ অফিসারকে নিয়ে ভ্যাটের মৌলিক ইস্যুগুলো তাদের সামনে তিনি ক্লিয়ার করেন। তার বক্তব্য ছিল খুবই গোছালো ও সুন্দর। এত ডেডিকেশন, এত এনার্জি- কিভাবে, কোথায় যে সে পেত?

ভ্যাটের এই কৃতিত্বের জন্য জাতি তাকে যদি স্বীকৃতি না দেয় তাহলে কাকে দেবে! এই অবদানের জন্য জনাব শাহ্ আবদুল হান্নানকে মরণোত্তর জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত করা উচিত বলে আমি মনে করি।

আমি সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালীন একদিন শাহ্ আবদুল হান্নান আমাকে ফোন করে বললেন, ‘ভাই সাহেব, আমি তো আপনার ওই অফিসে মাঝে মধ্যেই যাই। ওখানে সব কিছু আছে, সুন্দরভাবে আছে- ছয়তলায় চেয়ারম্যানের ঘর, বোর্ডের ঘর, এমডির ঘর- ইসলামের ঘর তো নেই, শুধু নামাজের ঘর নেই।’ আমি বললাম, জায়গা তো দেখি না। কয়েক মাস পরে খুব কথাটা মনে উঠতে লাগল। আমি নিজে নামাজ পড়তে গিয়ে দেখি কামরার মধ্যে লোকজন বসে, লোকজনকে বের করে দিয়ে নামাজের আয়োজন করতে হয়। আমার পিএসের একটি আলাদা রুম ছিল। সে রুমটিকে খালি করে পিএসকে আমার রুমের সামনে বসার ব্যবস্থা করি। আর ওই রুমটিতে নামাজের ব্যবস্থা করি।

আমার বন্ধু-বান্ধব, বিভিন্ন মহল থেকে অনেক অনুরোধ পাই লোনের ব্যাপারে, সুপারিশের ব্যাপারে। কিন্তু একমাত্র শাহ্ আবদুল হান্নানই আমাকে নামাজের ঘরের আবদার করেন। এর থেকে তার মানসিকতা বোঝা যায়। তিনি কত বেশি ধর্মের প্রতি, আল্লাহর প্রতি ডেডিকেটেড ছিলেন। তারপর থেকে এই ঘরেই নামাজের ব্যবস্থা চালু হয়ে যায়। এই কথাটি আমার খুব মনে পড়ে।

শাহ্ আবদুল হান্নানের সাথে আমি অনেক সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেছি। কাছে থেকে দেখেছি কত সংক্ষিপ্তভাবে, সুন্দরভাবে দেশ ও জাতির সমস্যা তুলে ধরে আগামী প্রজন্মকে ইসলামের দিকে আহŸান করেছেন। দেশের সমস্যা সমাধান করে কিভাবে দেশকে একটি কল্যাণরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা যায়, সেই ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন। তিনি সবসময়ই তার কাজের ফাঁকে, বড় দায়িত্ব পালনের মধ্যে ইসলাম প্রচারের সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েছেন। এ জন্য দেশের তরুণ-প্রজন্মকে গড়ে তোলার ব্যাপারে সবসময়ই চেষ্টা করেছেন। নিয়মিত পত্র-পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে এ কাজ অব্যাহত রেখেছেন। এক্ষেত্রে তার বহুমাত্রিকতা প্রশংসার দাবিদার। সবসময়ই তেজস্বী উদ্দীপনা নিয়ে কর্মব্যস্ত থাকতেন। এই বয়সে তার এই কর্মতৎপরতা দেখে মাঝে মধ্যে মনে হতো- কিভাবে তিনি এত এনার্জি পান?

তিনি ব্যক্তিস্বার্থ, লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে যেভাবে দেশের কল্যাণে কাজ করেছেন তাতে করে শুদ্ধাচারের পুরস্কার তারই পাওয়ার কথা। এই শুদ্ধাচার পুরস্কার একমাত্র শাহ্ আবদুল হান্নানেরই পাওয়া উচিত। আমি তার কলিগ সেক্রেটারি হিসেবে বলতে পারি, এ পুরস্কারটি তারই প্রাপ্য।

তিনি ছিলেন সততা ও ইসলামের মূল্যবোধের এক জ্বলন্ত প্রতীক। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাত নসিব করুন।

লেখক : সাবেক সচিব, সঙ্গীতজ্ঞ