Image description
এলাহী নেওয়াজ খান
 
 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার অতুলনীয় দেশপ্রেম ও আপসহীনতার কারণে। তিনি ক্ষমতার জন্য আপসের কোনো সস্তা পথ বেছে না নিয়ে যে দৃঢ়তা প্রদর্শন করে এসেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর বেগম খালেদা জিয়া একদম অজানা অবস্থায় স্বামীর দেশপ্রেমের পথে চলতে গিয়ে বহু বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে তার কাছে অনেক আপসের প্রস্তাব এসেছে—তা যদি তিনি গ্রহণ করতেন তাহলে এত দুর্দশার মধ্যে কখনো পড়তেন না।

এমনকি ক্ষমতার লোভে কোনো বিদেশি শক্তির ক্রীড়নকেও পরিণত হননি, পা দেননি আপসের কোনো চোরা পথে । আত্মা বিক্রি করে ক্ষমতার মসনদে বসার অভিলাষ কখনো তিনি দেখাননি। এজন্য দেশি-বিদেশি বহু ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি বারবার, বিনা দোষে খেটেছেন জেল-জুলুম।

২০০৯ সালের নীলনকশার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বেগম জিয়ার ওপর যে নির্যাতন নেমে এসেছিল, তা কেবল শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার কারণে নয়, বরং তা ছিল বাংলাদেশে সফররত ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা না করার খেসারত। তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগটি ছিল একটা অজুহাত মাত্র। কারণ ওই বিষয়টি ভারত ভালোভাবে নেয়নি। সে কারণেই প্রথমে তাকে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে অত্যন্ত অমর্যাদাকরভাবে বহিষ্কার করা হয়। তারপর তাকে দেওয়া হয় সাজানো মামলায় জেল।

পরবর্তী সময়ে অনেকেই বলেছিলেন, তখন যদি বেগম জিয়া প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা করতেন, তাহলে হয়তো এই কঠিন নির্যাতনের শিকার তিনি হতেন না। কিন্তু দেশপ্রেম তো অন্য জিনিস। এটা দৃঢ়তার সঙ্গে দেখাতে হয়। তিনি তা দেখিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে ইতিহাস বিচার করবে, তার সেই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, না সঠিক। শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, আরো অনেক ঘটনার মাধ্যমে তিনি দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

khaleda-14

 

যেমন ১৯৯১ সালের রোহিঙ্গা সংকটের কথা হয়তো অনেকের মনে আছে। তখন বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সবে সরকার গঠিত হয়েছে। অতীতের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসলেন। আর সে সময়েই সৃষ্টি হলো নজিরবিহীন রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট।

সেই সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। একটা পরাশক্তি তখন বেগম জিয়াকে মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেটা মেনে নিলে বাংলাদেশকে দেয়া হতো বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, দেওয়া হতো বিপুল আর্থিক সহায়তা। বেগম জিয়া দেশের স্বার্থে সে প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। তিনি চীনসহ অন্য সবার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করার পক্ষে ছিলেন।

তখন যদি তিনি সেই পরাশক্তির প্রস্তাব মেনে নিতেন, তাহলে ’৯৬ সালের চরম নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী আন্দোলনের সম্মুখীন হতেন না। কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে প্রথমে আন্দোলনটি জামায়াতে ইসলামী শুরু করলেও পরে এটার নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। আপাতদৃষ্টিতে এই আন্দোলনের নেপথ্যে ভারতের ভূমিকা ছিল বলে অনেকে মনে করলেও কার্যত এর পেছনে প্রতিবেশী দেশসহ ওই পরাশক্তির ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

পরবর্তী সময়ে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউয়ের নেতৃত্বে ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনার কথাই ধরা যাক। এ ঘটনার পেছনে প্রতিবেশী একটি দেশসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। সে কারণেই বেগম খালেদা জিয়া ওয়ান-ইলেভেনের ওই কুচক্রীদের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যেতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি এই চক্রান্তের কাছে মাথা নত করেননি।

তিনি জানতেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে মাথা নত করেননি বলেই শহীদ হয়েছিলেন। সুতরাং এ কারণে অনেকেই বলে থাকে, তখন যদি তিনি আপসের পথ বেছে নিতেন, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।

নিশ্চয়ই এটা অনেকের স্মরণ আছে, ওয়ান-ইলেভেন ঘটানোর পর জেনারেল মইন ইউ দিল্লি সফরে যান। তখন তাকে অনেক ঘোড়া উপহার দেওয়া হয়েছিল। সাধারণত ভারতীয়রা বশ্যতা স্বীকারকারীদের এ ধরনের ঘোড়া উপহার দিয়ে থাকে। এতেই ভারতের প্রতি তার আনুগত্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

এদিকে বেগম জিয়া ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের প্রস্তাব না মানলেও অপর নেত্রী তা মেনে নেন। ফলে ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করে এবং নিবর্তনমূলক এক শাসন জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়।

অন্যদিকে ১৯৮২ সালে জনগণের বিপুল ম্যানডেট পাওয়া বিএনপি সরকারকে হটিয়ে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে একটা সমঝোতা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে প্রথমে তিনি বেগম খালেদা জিয়ার কাছে ধরনা দিয়েছিলেন।

ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষিত এই জেনারেল ক্ষমতা দখলের পরই দেশবাসী বুঝে গিয়েছিলেন, এর নেপথ্যে কারা ছিল। যদিও বেগম জিয়া তখন সবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন, কিন্তু জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বেগম জিয়া ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন এরশাদের ভারতপ্রীতির কথা। তাই এরশাদের সমঝোতার প্রস্তাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন। সে কারণেই তিনি এরশাদের সময় কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি।

এভাবেই খালেদা জিয়া বারবার দেশপ্রেমের অসাধারণ সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রচণ্ড চাপ ও নির্যাতনের মুখে মাথা নত করেননি। আর সেটা থেকেই দলের নেতাকর্মীরা যেকোনো ষড়যন্ত্রের মুখে দেশপ্রেমে অবিচল থাকার অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন। সে কারণেই দলের দু-একজন এদিক-ওদিক করলেও এবং ওয়ান-ইলেভেন ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভয়াবহ নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হলেও নেতাকর্মীরা ভেঙে পড়েননি, কিংবা চাপের মুখে আওয়ামী লীগেও যোগদান করেননি।

আজ এই সংকটকালে বেগম জিয়ার সেই স্মরণীয় উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘ওদের হাতে গোলামির জিঞ্জির।’ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত বড় বড় হরফে লেখা ওই শিরোনামটি এখনো আমাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে কোনো এক জনসভায় তিনি আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে ওই কথাটা বলেছিলেন। এখানে উল্লেখ করতে হয়, বেগম খালেদা জিয়া দুঃসহ এক মর্মবেদনা নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন। তিনি জানতেন, জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্রকারীরা জড়িত ছিল।

তাই কখনোই তিনি সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা ভুলে যাননি। তখন ভারতের বিখ্যাত ইংরেজি ম্যাগাজিন ‘দি সানডের’ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর কর্মকর্তারা একটি ফাইল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের কাছে নিয়ে যান। তাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার অনুমতি প্রার্থনা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী দেশাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। তিনি অন্য দেশের একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন এবং ফাইলটি ফিরিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে যখন ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসেন, তখন ফাইলটি আবার চালু হয়।

তাই এটা আজ প্রমাণিত সত্য, বেগম খালেদা জিয়া কখনোই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে আপস করেননি। সেজন্যই তিনি আপসহীন নেত্রী উপাধিতে ভূষিত। তার এই অসামান্য দেশপ্রেমের দৃষ্টান্তই দলের নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস। সেই প্রেরণার উৎস বেগম খালেদা জিয়া এখন অসুস্থ। লন্ডনে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে এলেও আগের মতো আর রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারছেন না।

তাই দেশের এই সংকটকালে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সেই সাহস ও প্রেরণা থেকে জাতি বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে জনগণের প্রিয় দল বিএনপিতে কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটে গেছে। কোথায় যেন হিসাব-নিকাশের গরমিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। যাদের কারণে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন, যাদের কারণে বেগম খালেদা জিয়া নিজে নিদারুণ নির্যাতন, নিপীড়ন ও জুলুমের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তারাই বুঝি আজ দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। তাই এখন বেগম জিয়ার সেই ঐতিহাসিক উক্তিটি বারবার মনে পড়ছে—‘ওদের হাতে গোলামির জিঞ্জির।’