Image description

দশ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছেন আরব আলী। শুরুর দিকে মাসে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা খরচ হতো চিকিৎসার পেছনে। এক দশকের ব্যবধানে আরব আলীর চিকিৎসাব্যয় বেড়েছে চারগুণ। চিকিৎসাব্যয় মেটাতে একমাত্র সম্বল মুদি দোকান বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাকে। প্রতি মাসে একবার রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে আসেন শরীয়তপুরের এই বাসিন্দা।

গত ১৫ মে আরব আলী আমার দেশকে বলেন, ডায়াবেটিস ধরা পড়ার কিছুদিন পর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। শুরু থেকেই ইনসুলিন নিতে হয়েছে। একসময় যা ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় পাওয়া যেত, এখন তা দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। সঙ্গে অন্যান্য ওষুধ তো আছেই। ফলে আগে এক হাজার টাকার মধ্যে পুরো মাস চললেও এখন চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা চলে যাচ্ছে।

সরকারি হিসাবে, গত এক দশকে দেশে হাসপাতাল ও ক্লিনিক বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সরকারের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। সে অনুযায়ী চিকিৎসাব্যয় কমে আসার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। চিকিৎসাব্যয়ের পাগলা ঘোড়া ছুটছেই। এ সময় ব্যক্তির চিকিৎসাব্যয় বেড়েছে প্রায় আড়াইগুণ। দফায় দফায় ওষুধের দাম বৃদ্ধি, রোগ নির্ণয়ে উচ্চমূল্য, বেসরকারি হাসপাতালকে ক্যাটাগরি করতে না পারায় বেড়েই চলেছে চিকিৎসাব্যয়।

তবে চিকিৎসাব্যয় বৃদ্ধির পেছনে শুধু এসব কারণই দায়ী নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রতিনিয়ত রোগের ধরন পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন নতুন রোগ ধরা পড়ছে, সে অনুযায়ী ওষুধ ও রোগ নির্ণয় প্রযুক্তি আবিষ্কার হচ্ছে। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহারের প্রবণতা চিকিৎসাব্যয় বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত মানোন্নয়নে জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ এবং জিডিপির ৫ শতাংশ ব্যয়ের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে কখনোই ৫ শতাংশের বেশি বরাদ্দ রাখেনি বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ক্রমাগত বাড়লেও গত এক দশকে বাংলাদেশ একই জায়গায় রয়ে গেছে।

সরকারের স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের তথ্যমতে, স্বাস্থ্য খাতে বেশকিছু অর্জন ও কিছু সূচকের অগগ্রতি হলেও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এখনো জনতুষ্টি আসেনি। যার সবচেয়ে বড় সংকট কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দ না পাওয়া। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে বরাদ্দের প্রথম তিনটি খাতের মধ্যে স্বাস্থ্য থাকলেও বাংলাদেশে তা অনেক পিছিয়ে। এমনকি একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ।

এ অঞ্চলের সবচেয়ে দুর্বল দেশ আফগানিস্তানে যেখানে মাথাপিছু চিকিৎসাব্যয় ৮২ ডলার, বাংলাদেশ সেখানে ব্যয় করে মাত্র ৫৮ ডলার। অথচ নেপালে ৬৭ ডলার, ভারতে ৭৪ ডলার, ভুটানে ১০৪ ডলার, মিয়ানমারে ৭১ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১৫৭ ডলার এবং মালদ্বীপ প্রতি জনের পেছনে চিকিৎসার জন্য ব্যয় করে এক হাজার ৫৭ ডলার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১০ সালের পর থেকে চিকিৎসা খাতে সরকারের ব্যয় ক্রমাগত কমেছে। ফলে বেড়েছে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয়। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। ২০১২ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট প্রণীত ‘স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্রে’ বলা হয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে ৩২ শতাংশে আনা হবে। এই কৌশলপত্র প্রণয়নের সময় স্বাস্থ্যব্যয়ের ৬৪ শতাংশই বহন করতে হতো ব্যক্তিকে, সরকার দিত ২৬ শতাংশ আর অন্যান্য উৎস থেকে আসত ১০ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে প্রতি বছর। বর্তমানে ৭৩ শতাংশ হয়েছে।

ওষুধ ব্যবহারে শীর্ষে বাংলাদেশ

দেশে স্বাস্থ্যব্যয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যায় কেবল ওষুধের পেছনে। অপ্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবহার নিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদরা বিভিন্ন সময় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বললেও এর খুব একটা প্রভাব পড়েনি।

স্বাস্থ্য কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে চিকিৎসাব্যয়ের ৬২ শতাংশই যায় কেবল ওষুধের পেছনে। এই খরচের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ দেশগুলোর একটি। স্বাস্থ্য খাতে ওষুধের খরচে বৈশ্বিক গড় ব্যয় ১৫ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যপ্রযুক্তি ও ক্লিনিক্যাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএ-র তথ্যমতে, স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ে ওষুধের খরচ সবচেয়ে কম করে যুক্তরাজ্য। দেশটিতে স্বাস্থ্যসেবার মাত্র ৯ শতাংশ ব্যয় করে ওষুধের পেছনে। এর পরই রয়েছে কানাডা। তারা স্বাস্থ্যসেবার মাত্র ১০ শতাংশ ব্যয় করে ওষুধের পেছনে। পাশাপাশি ব্রাজিলে এই হার ১৩ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় ১৪ শতাংশ, ফ্রান্সে ১৫ শতাংশ, জার্মানি, জাপান ও ইতালির মতো উন্নত দেশগুলোতে এই হার ১৭ শতাংশ। এছাড়া স্পেনে ১৮ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ আমার দেশকে বলেন, আগে যে ধরনের রোগ ছিল, এখন তার ধরন পাল্টে গেছে। বর্তমানে অসংক্রামক রোগই বেশি। যা ব্যক্তিগত রোগ, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার ধরন, বৈশ্বিক রোগের ধরন পাল্টে যাওয়ায় রোগী বাড়ছে। এর জন্য নতুন নতুন ওষুধ আসছে বাজারে। ওষুধের অপ্রয়োজনীয় এই ব্যবহারের লাগাম টানতে হলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

ওষুধের দাম বাড়ে কোম্পানির ইচ্ছায়

দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চার হাজার ১৮০টি জেনেরিকের ৩৫ হাজার ২৯০টি ব্রান্ডের ওষুধ তৈরি করে। এর মধ্যে প্রায় হাজারের মতো ওষুধ অত্যাবশকীয় হলেও সরকারের তালিকাভুক্ত মাত্র ১১৭টি। কিন্তু চিকিৎসকদের লেখা ব্যবস্থাপত্রে এসব ওষুধের নাম নেই বললেই চলে। এই সুযোগে ওষুধের পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে কোম্পানিগুলো। সুযোগ পেলেই বাড়িয়ে দিচ্ছে দাম। দীর্ঘদিন ধরে ওষুধের দাম নির্ধারণে নীতিমালা প্রণয়ণের দাবি উঠলেও অজানা কারণে উদ্যোগ নিয়েও বার বার ভেস্তে যায়। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই গত দেড় দশকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে হাজারের বেশি অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধ বাজারে এসেছে। কিন্তু গত ৩২ বছরেও সরকার নিয়ন্ত্রিত সেই অত্যাবশকীয় ওষুধের তালিকায় একটিও যুক্ত হয়নি। যার কারণে পুরো বাজার সরকার নয়, কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে ওষুধের পেছনে ব্যয় বাড়ছে। অথচ ডাক্তার ফি, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ও আইসিইউর বিল নিয়ে কথা উঠলেও ওষুধ নিয়ে আলোচনা নেই।

রোগ নির্ণয় ফি নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা

শুধু ওষুধ নয়, স্বেচ্ছাচারিতা চলছে রোগ নির্ণয়েও। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো ইচ্ছেমতো রোগ নির্ণয়ের ফি নির্ধারণ করে—এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। রোগ নির্ণয়ের ফি নির্ধারণে কোনো নীতিমালা না থাকায় একই রিএজেন্ট (পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপকরণ) ব্যবহারেও একই টেস্টের দাম একেক প্রতিষ্ঠানে একেকরকম। আবার বিগত কয়েক বছর ধরে ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে অধিকাংশ টেস্টেও দাম বাড়ানো হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কোনো প্রতিষ্ঠানে আগে যেসব সেবায় মূল্যছাড়ের সুযোগ ছিল, সেটি সীমিত হয়ে এসেছে। ফলে রোগ নির্ণয় করতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন রোগীরা।

সংকট নিরসনে ২০২২ সালে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্যাটাগরিভিত্তিক করার উদ্যোগ নেয় সরকারের স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অসহযোগিতায় তা তিন বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে একই পরীক্ষার মূল্য একই মানের পাঁচ প্রতিষ্ঠানে পাঁচরকম।

রক্তে কোলেস্টেরল ও চর্বির পরিমাণ জানতে সাধারণ একটি রক্ত পরীক্ষা লিপিড প্রোফাইল। রাজধানীর ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এটি ৯০০ টাকা হলেও একই মানের এএমজেড হাসপাতালে ১২শ, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ-এ (আইসিডিডিআর,বি) ১ হাজার ২৬০ টাকা, লাইফ কেয়ার মেডিকেল সেন্টারে ১৩শ এবং ল্যাবএইডে ১ হাজার ৪৩০ টাকা।

একইভাবে প্রেগন্যান্সি আল্ট্রাসনোগ্রাফির দাম ইবনে সিনায় যেখানে ১ হাজার ৫০ টাকা সেখানে এএমজেড ও লাইফকেয়ারে ১৫শ টাকা, পপুলারে ২ হাজার টাকা আর ল্যাবএইডে ৩ হাজার ৫২০ টাকা। সে অনুযায়ী, একই মানের প্রতিষ্ঠানে দামের পার্থক্য দুই হাজার ৪৭০ টাকা।

মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যানে এএমজেড, লাইফকেয়ার ও ইবনে সিনায় ৪ হাজার টাকা হলেও পপুলার এবং ল্যাবএইডে তা ৫ হাজার টাকা। বুকের এক্সরের দাম আইসিডিডিআর,বিতে ৮০০ টাকা হলেও ল্যাবএইড ও লাইফকেয়ারে ২০০ টাকা কমে হচ্ছে ৬০০ টাকায়। আর ৫০০ টাকায় মিলছে এএমজেড হাসপাতালে। এমআরআই নেক ও চেস্টের দাম যেখানে এএমজেডে ৮ হাজার টাকা, সেখানে ল্যাবএইডে ১২ হাজার টাকা।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল হামিদ আমার দেশকে বলেন, ২০১০ সাল থেকে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় ক্রমাগত কমেছে। আমাদের চিকিৎসাব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশই বহন করতে হচ্ছে রোগীকে। অন্যান্য দেশে সাধারণত যেখানে ব্যক্তি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বহন করে, সেখানে আমাদের করতে হচ্ছে ৭৩ শতাংশ। সরকার যদি সিংহভাগ বহন করতো, তাহলে আমাদের খরচ কমে যেত। এজন্য ওষুধের দামে লাগাম টেনে ধরতে হবে, যার প্রধান কাজ ওষুধের ব্যবহার যৌক্তিক করা।

এই অধ্যাপক আরো বলেন, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া আমরা নিজেরা ওষুধ কিনে এনে খাচ্ছি, আবার ফার্মেসি দোকানেও সমস্যার কথা শুনেই ওষুধ দিচ্ছে। এছাড়া আছে পল্লি চিকিৎসক। এমনকি আমাদের চিকিৎসকরাও ব্যবস্থাপত্র প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথভাবে লিখছেন না। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় আমরা বেশি ওষুধ খাচ্ছি। এটি চিকিৎসাব্যয় বাড়ার দুটি প্রধান কারণের একটি। এজন্য কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী মার্কেটিং বন্ধ করতে হবে। সেটি করতে হলে দরকার সরকারের শক্ত পদক্ষেপ। বিশেষ করে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা থাকতে হবে।

রোগ নির্ণয় ফিতে স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনার পরামর্শ দেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের রেফারেল কমিশন বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি ক্যানসার, ডায়াবেটিস, কিডনির মতো জটিল রোগের জন্য তহবিল গঠন করতে হবে। যার সুফল দরিদ্রদের পাশাপাশি সব শ্রেণি-পেশার মানুষ পাবে।