Image description
 
 

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অন্য দেশের নগরগুলোর দিকে তাকালে আমরা একটা সাধারণ সত্য দেখতে পাই। সেটা হলো অতিমাত্রার কেন্দ্রিকতা। দেশের মোট সম্পদের বিশাল অংশটি রাজধানী শহর কিংবা একটা-দুটি নগরে এসে জমা হচ্ছে। এর মানে হচ্ছে সারা দেশ থেকে সম্পদ শুষে এনে নগরগুলো পুষ্ট হচ্ছে। সেই সম্পদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত রাজধানীতে পাচার হয়ে আসছে অজস্র কাজ হারানো, সম্পদ হারানো, নিঃস্ব মানুষ।

ঢাকার ক্ষেত্রে আমরা দেখি, রাতের ফুটপাতে ত্রিপলের ছাউনি থেকে শুরু করে বস্তিতে কাতারে কাতারে মানুষ এসে আশ্রয় নেয়। রিকশা চালিয়ে, ফুটপাতে পিঠা বিক্রি করে, গাড়ির হেলপারি করে, বাসায় রান্না করে, রাস্তা, ড্রেন সাফসুতরো করে, তাদের বেঁচে থাকার লড়াইটা সত্যিকারের প্রাগৈতিহাসিক জীবনের লড়াই।

নগরকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটা পর্যায় পর্যন্ত এই মানুষগুলোকে দরকার। সে কারণেই বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনীদের এলাকা গুলশানের কাছেই সর্ববৃহৎ কড়াইল বস্তি থাকে। কিন্তু ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থানের সুযোগ এতটাই সীমিত হয়ে যাচ্ছে যে ঢাকামুখী জনস্রোত কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না।

এই মানুষগুলোর জীবনের নির্মম দিকটা হলো তঁাদের জীবন আর রাষ্ট্রীয় উচ্ছেদ একই সমান্তরালে চলতে থাকে। নগরের অর্থনীতি, নগরের স্বাস্থ্য, নগরের মানুষের জীবনযাপনের স্বাচ্ছন্দ্য—সবটার জন্য এই লোকগুলো অপরিহার্য হলেও রাষ্ট্র, অভিজাত সম্প্রদায়, এমনকি মধ্যবিত্তের অনেকের কাছে ‘উটকো’ নাগরিক। ফলে যেকোনো আমলেই বুলডোজারের সঙ্গে তঁাদের নিয়তি প্রবলভাবে বাঁধা। 

 

গত সপ্তাহে ঢাকা আবারও বুলডোজারের আতঙ্কজাগানিয়া ঘর্ঘর আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। সেই আওয়াজ ছাপিয়ে গেছে বুকফাটা কান্না, আর্তনাদ আর আর্তিতে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে, জীবনের সম্বল ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বুলডোজারে গুঁড়িয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে সিটি করপোরেশনের কর্মীদের সঙ্গে রিকশাচালকের প্রাণপণ প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পেলাম। রাষ্ট্রযন্ত্রের সামনে এই সামান্য রিকশাচালকের হাত জোড় করে তাঁর জীবিকার সম্বল রক্ষা করার আকুতি কতটা ম্যাটার করে। বুলডোজার যখন অটোরিকশা পিষে ফেলছিল, তখন রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে খেতে রিকশাচালক যে প্রশ্নটি (চারডা পোলাপান, এহন ক্যামনে চলমু ভাই? এইডা কি স্বাধীন বাংলাদেশ ভাই?) করেছেন, তার উত্তর কি কারও কাছে আছে? 

ভিডিওটি দেখে মনে পড়ে গেল, ৯ মাস আগে ৫ আগস্ট দুপুরে ঢাকার রাস্তা যে জনারণ্যে পরিণত হয়েছিল, সেখানে মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি প্রথম উচ্চারণ করতে শুনেছিলাম একজন রিকশাচালককে। শ্রমজীবী এই মানুষগুলোই ছিলেন অভ্যুত্থানের সড়কযোদ্ধা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কড়া প্রতিক্রিয়া হলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ ইজাজ তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিয়ে ‘কড়া মেসেজিং দেওয়ার’ জন্য তিনটি রিকশা ভাঙার পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছেন, সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘আজকে যে তিনজনের রিকশা ভাঙা হয়েছে, তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। মেইন রোডে না আসার জন্য এবং কড়া মেসেজ দেওয়ার জন্য তিনটি রিকশা ভাঙা হয়েছিল। আমরা পরিবারগুলোকে আয়ের বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছি।’

রাষ্ট্রযন্ত্র মানবিক হবে বলেই, তাদের দিকে ফিরে তাকাবে বলেই শ্রমজীবী মানুষগুলো জানের মায়া না করেই বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৯ মাসের মাথায় এসে তাঁরা যখন চোখের সামনে বাঁচার শেষ অবলম্বনটুকু হারাতে দেখে ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, সেই আওয়াজ কিন্তু বুলডোজারের চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী। 

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সেদিনের অভিযানে ১৮টি অটোরিকশা জব্দ করা হয়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটির আমিনবাজার কাঁচাবাজারের জায়গায় ডাম্পিংয়ে যার ১৬টিকে ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়। আর দুটি রিকশা অক্ষত অবস্থায় ছিল। উত্তর সিটির প্রশাসক কি এই ১৮ জন রিকশাচালককে ক্ষতিপূরণ দেবেন, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন? অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ঢাকার রাস্তায় প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল তো হরহামেশাই বড় বড় আইন ভাঙে। এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে একই ধরনের শাস্তি দিতে পারবে?

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে গত কয়েক মাসে অটোরিকশা ঢাকার অরাজক সড়ককে নৈরাজ্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। প্রায় দুই কোটি মানুষের রাজধানী শহর ঢাকা এমনিতেই বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর। দ্রুত, মাঝারি, ধীরগতির মিলিয়ে প্রায় ১৮ ধরনের যানবাহন চলাচল করে। ব্যাটারিচালিত রিকশার মূল সমস্যা এর নিয়ন্ত্রণহীন গতি। ব্রেকিং সিস্টেম দুর্বল হওয়ায় এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বাহন। দুর্ঘটনার দিক থেকে মোটরসাইকেলের পর বাংলাদেশের অন্যতম ঝুঁকির যান হয়ে উঠেছে অটোরিকশা।

ঢাকার অটোরিকশাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা দরকার—এ ব্যাপারে কেউই দ্বিমত করবেন না। কিন্তু সেটা করার জন্য বুলডোজারের ব্যবহার কেন করতে হবে। সরকার ঢাকার মূল সড়কে অটোরিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন কি রাতারাতি করা যাবে? একটা নতুন আইন হলে, সেই আইনের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে তো সময় দিতে হয়। টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার জন্য প্রচার চালাতে হয়। মাইকিং করে সতর্ক করতে হয়। এরপর ধাপে ধাপে সেটা বাস্তবায়নের প্রশ্ন আছে।

গত সপ্তাহে ঢাকা আবারও বুলডোজারের আতঙ্কজাগানিয়া ঘর্ঘর আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। সেই আওয়াজ ছাপিয়ে গেছে বুকফাটা কান্না, আর্তনাদ আর আর্তিতে।ছবি : প্রথম আলো

এ তো গেল আইন আর আচরণের প্রশ্ন। এখানে গভীর প্রশ্নটি হলো কর্মসংস্থানের। শেখ হাসিনার আমলে উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির গল্প চলেছে সমানতালে। কিন্তু তার বিপরীতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। গত এক দশকে কর্মসংস্থানের কথা যদি বলি, সেটা একমাত্র এই অনিশ্চিত অটোরিকশা খাতে।

গবেষক মাহা মির্জার মতে, এই সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স ৯ মাস পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে তারা ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে একটু থিতুর মধ্যে আনতে পারলেও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে চিত্রটা হতাশাজনক। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। পোশাকশিল্পেই কেবল ৭৬ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। নির্মাণশিল্পেও কাজের সুযোগ কমেছে। পেঁয়াজ, শীতের সবজি, আলুতে একের পর লোকসানে পুঁজি হারিয়েছেন অসংখ্য কৃষক। বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, এ বছর ৩০ লাখ লোক অতিদরিদ্র হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে কাজ হারানো, পুঁজি হারানো, গরিব হওয়া মানুষেরা যদি ঢাকায় এসে অটোরিকশা চালাতে শুরু করেন, তাহলে সেই জনস্রোত কি বুলডোজার দিয়ে আটকানো যাবে?

রাষ্ট্রযন্ত্র মানবিক হবে বলেই, তাদের দিকে ফিরে তাকাবে বলেই শ্রমজীবী মানুষগুলো জানের মায়া না করেই বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৯ মাসের মাথায় এসে তাঁরা যখন চোখের সামনে বাঁচার শেষ অবলম্বনটুকু হারাতে দেখে ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, সেই আওয়াজ কিন্তু বুলডোজারের চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী। 

 মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী