
শাহীদ কামরুল
একাত্তর একটি মীমাংসিত ইতিহাস, কিন্তু অমীমাংসিত রাজনীতি। ৭১ মীমাংসা করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে পূর্বে। আমি মনে করি, ৭১-কে বোঝার জন্য শুধু হিস্টোরিওগ্রাফি ও হিস্টোরিওসিটি যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে নিওহিস্টরিসিজম থাকা প্রয়োজন। কারণ ৭১ নিয়ে আমরা অসংখ্য ট্রাজেক্টরি বানিয়ে তার মধ্যে বেশুমার ট্যাপিস্ট্রি ইনপুট করেছি এবং করে যাচ্ছি।
৭১ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্লাঘা ও আত্মত্যাগের প্রতীক, এটি বিতর্কের বিষয় নয়, বরং মীমাংসিত সত্য। কিন্তু ৭১ নিয়ে বারবার রাজনৈতিক স্বার্থে বিতর্ক হয়েছে এবং হচ্ছে। একাত্তরের ইতিহাসকে রাজনৈতিক অস্ত্র বানিয়ে দেশের ভেতরে বিভাজন ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে, এখনো করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতের মোমেন্টাম হিসেবে একাত্তরকে কায়েম রাখার জন্য জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা জরুরি ছিল। ৭১ সর্বজনীন, কোনো দলই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে একচেটিয়া সম্পদ বানাতে পারে না। আজকের বাংলাদেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী নেই। যারা নিজেদের হীনস্বার্থে ২০২৫ সালে এসে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি খোঁজে, তাদের সন্দেহের চোখে দেখতে হবে, এরা ভারতের বয়ান ফেরি করছে, আবার দেশকে দুই ভাগে ভাগ করে সেই পূরণের নোংরা রাজনৈতিক খেলা খেলতে চায়।
৭১-এর হত্যাকাণ্ডের জন্য যাদের নামে মামলা ছিল, তাদের সামান্য শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেন শেখ মুজিব এবং জিয়াউর রহমান। সেই মামলায় জামায়াতের নেতারা কেউ ছিলেন না। ৭১-এর মামলায় যেসব জামায়াত নেতাকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দেশের কোথাও ৭১/৭২ সালের কোনো মামলা ছিল না। ঘটনার ৫০ বছর পর জামায়াতকে ঘায়েল করতে নতুন করে মামলা দিয়ে বিচারের নামে হত্যা করা হয়। এই জুডিশিয়াল কিলিং হয়েছে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে।
৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ করেছে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের সহযোগিতার জন্য ৭৩ সালে ট্রাইব্যুনালে মামলা, বিচার ও সাজা হয়েছে। সে সময় লক্ষাধিক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। মোট মামলা ছিল ৩৭৪৭১টি, বিচার হয় ২৮৮৪টির, সাজা হয় ৭৫২ জনের, ক্ষমা করা হয় ৩৬,৪০০ জনকে। সাজাপ্রাপ্ত আসামি বা ক্ষমাপ্রাপ্ত আসামি কোনো তালিকায় জামায়াত নেতাদের কেউ ছিলেন না। অথচ ৭১-এর চেতনার কথা বলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবিদার দলটি বাংলাদেশকে কার্যত ভারতের উপনিবেশে পরিণত করেছিল।
এবার আসি বিএনপির প্রসঙ্গে। বিএনপি নেতারা এখন নতুন করে বাকশালীদের মতো যুদ্ধাপরাধীর পুরোনো সুর তুলছে। কারণ জামায়াতকে কোণঠাসা করার জন্য তাদের হাতে এটাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। আমরা একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকালে দেখব শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কীভাবে কাদের নিয়ে বিএনপি গঠন করেছিলেন। তিনি ক্ষমতায় গিয়ে ১৯৭৬ সালে যে দলটি গঠন করেছিলেন, সেই দলে অনেক মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী সবচেয়ে দল মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী সেই দলে যোগ দেন।
বিএনপি সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, বিএনপির প্রতিষ্ঠিতা সদস্য জিয়ার আমলের মন্ত্রী আব্দুল আলিম, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাবা, সাবেক মন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা মির্জা রুহুল আমীন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরুর বাবা মাহমুদুন্নবী চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী, আব্দুর রহমান বিশ্বাসসহ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে থাকা অনেক নেতাকর্মীই বিএনপি ও জিয়াউর রহমানের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন । এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের রাজনীতিতে পুনঃপ্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ার অপরাধও সমানভাবে বিচারযোগ্য, যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া, একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানানো ও তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনীতি করাও অপরাধ।
৭১-এর পর থেকে অনেক যুদ্ধাপরাধী আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তাদের কি বিচার হবে? আওয়ামী শাসনামলে যুদ্ধাপরাধীদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে জামায়াতের মাত্র ৩৭ জন, বিএনপির ১০২৪, আওয়ামী লীগের ৮০৬০ এবং অন্যান্য দলের ৮৭৯ জন ছিল। তারেক রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়াও একসময় বলেছেন, জামায়াত যুদ্ধাপরাধী না, এখন তাদের দলের নেতারা রাজনীতির স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য উল্টোকথা বলছেন, যা খুবই দুঃখজনক। দেশের মানুষ এখন আর পুরোনো এসব কেচ্ছা শুনতে চায় না, কারণ জুলাই বিপ্লবের পর দেশের মানুষের মনোজগতে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে।
আর এনসিপির সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের একটা দ্বন্দ্ব সময়ের ব্যাপার ছিল। ফার রাইট, জামায়াতের সঙ্গে ডান-বাম-সুশীলের খিচুড়ি এবং জেন-জি জেনারেশন থেকে হঠাৎ করে রাজনীতিতে নেমে যাওয়া এনসিপির সদস্যদের একসঙ্গে পথচলাটা সহজ হওয়ার কথা ছিল না। এর আগেই জুলাই বিপ্লবীদের তথা সাবেক শিবিরের একটা দল এনসিপি থেকে আলাদা হয়ে আপ বাংলাদেশ নামক রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গঠন করেছে। একসঙ্গে থাকাটা এমনিতেও খুব বেশিদিন লাস্টিং করত না। কারণ সাইকোলজিক্যাল ডিসটেন্স অবশ্যই থাকত। তা ছাড়া হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা নেতারা তাদের নিজেদের জন্য হুমকি মনে করছিলেন, কারণ তারা দলের মধ্যে অনেক বেশি ডকুমেন্ট ছিল এবং তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা অনেক বেশি, ফলে এটা একসময় এমনিতেই ভেঙে যেত।
এনসিপির গোস্বা করার কারণ হলো, জামায়াত-শিবিরের স্বনামে শাহবাগে অংশগ্রহণ, ইসলামি আন্দোলন ও হেফাজত-কওমি ধারা নিজ নিজ ব্যানারে অংশগ্রহণ করায় এনসিপি পুরা ক্রেডিট নিতে পারেনি। জুলাই আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত-সাধারণ জনতার অংশগ্রহণ ছিল, কিন্তু কেউ নিজ নামে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, ফলে ক্রেডিট এনসিপির বাক্সে। কিন্তু হাসিনার পতনের পর সে চিত্র পাল্টে গেছে। এখন সবাই নিজ নিজ নামে অংশগ্রহণ করতে পারছে।
এনসিপি শুরু থেকেই ২৪-এর ওপর একক আধিপত্য কায়েম করতে চাচ্ছিল, এখন তারা ৭১-এ ফিরে যেতে চাচ্ছে। ৭১ তো মুজিবময়। ৭১-এর চেতনা ব্যবসা যা করার আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে করে ফেলেছে। সেখানে আর কিছু নেই। এখন ৭১ কচলানো অনেকটা লেবুর মতো হয়ে গেছে, এখন কচলালে শুধু তিক্ততাই বের হবে। তাদের বাংলা ছাড় টাইপের স্লোগান বাড়াবাড়ি। আবার তাদের জাতীয় সংগীত গাইতে বাধা দেওয়া হয়েছে, এটার প্রতিবাদও জরুরি ছিল। কারো পছন্দ না হলে সে নিজে না গাক, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এটা অফিশিয়াল জাতীয় সংগীত, ততক্ষণ পর্যন্ত বাধা দেওয়ার অধিকার কারো নেই। তাই প্রতিবাদটা জরুরি ছিল। কিন্তু সেই প্রতিবাদের সীমা ছাড়িয়ে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মতো আয়োজনের কোনো দরকার ছিল না।
বিশেষ করে বাগছাসের অনেকে যেভাবে আওয়ামী লীগের সেই চেতনার বয়ানগুলো পুনর্জীবিত করছে, সেটা ভালো কিছু না। এনসিপি অতিরিক্ত সুশীল বা বামঘেঁষা হতে গেলে ভুল করবে। ওটার জন্য অন্য অনেক দল আছে। এনসিপির ডানঘেঁষা হওয়াই উচিত। একই সঙ্গে একাত্তর নিয়ে কোনো হীনম্মন্যতায় ভুগবে না, কিন্তু অতি সুশীলগিরিও করবে না, সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু বঞ্চিত বাঙালি মুসলমানের পক্ষে কথা বলবেÑএ রকম হতে না পারলে এনসিপির আলাদা রাজনীতি দাঁড়াবে না। পরিশেষে ফেডরিক জেমসনের উক্তি দিয়ে শেষ করব। তিনি বলেন, পোস্টমডার্নিজম মানে হলো এন্ডিং অব দ্য ট্রেডিশনাল আইডিয়াস অর্থাৎ প্রথাগত ধারণাগুলোর অবসানটাই হলো উত্তর আধুনিকতাবাদ। আর উত্তর আধুনিক যুগে বাস করে পুরোনো নেরাটিভগুলোকে কছলাকছলি না করে ইউনিভার্সিলিটি এর থেকে অগ্রসর হওয়া উচিত বলে মনে করি আর তাতেই সবার জন্য কল্যাণ নিহিত।
লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক, ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি