শামীমুল হক
প্রাণের হাসু আপা, আপাগো? কথাডা শুইন্না এক্কেবারে আকাশ থেইক্কা পড়ছি। মনে নানা প্রশ্ন জাগছে। আসলে কথাডা কি হাছা?
প্রিয় আপা, খবর বেরিয়েছে অফশো’র অ্যাকাউন্টে আপনি নাকি অর্থ পাচার করতেন। এতদিন আপনার চ্যালা-চামুণ্ডাদের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের খবর পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। আপনার এক চামুণ্ডা এস আলম গ্রুপ দেশের একের পর এক ব্যাংক দখল করেছে। আপনি অতি উৎসাহী হয়ে তাকে সমর্থন দিয়েছেন। ব্যাংক দখলের ঘটনা পৃথিবীতে বাংলাদেশেই প্রথম। আর সেটা হয়েছে আপনার নেতৃত্বে। এসব পুরনো খবর। নতুন খবর যেটা তা হলো- আপনিসহ আপনার পরিবার এখন অর্থ পাচারকারীর লিস্টে নাম লিখিয়েছেন। আপনি ও আপনার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সাড়ে ১৫ বছরে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের টিমও গঠন করেছে দুদক। দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে এই কমিটি গঠন করা হয়। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- উপ-পরিচালক সাইদুজ্জামান নন্দন, সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া, এসএম রাশেদুল হাসান ও একেএম মর্তুজা আলী সাগর। বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগের পরিচালককে এই টিমের তদারককারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। আপনি এবং আপনার বোন শেখ রেহানা, পুত্র জয়সহ আপনার পরিবারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানকালে তাদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধকরণ, সম্পদ জব্দ বা ক্রোক করতে পারবে এই কমিটি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি বা ৫৯ হাজার কোটি টাকাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ওঠা ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ আপনার পরিবারের বিরুদ্ধে। এ জন্যই অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছে দুদক। রূপপুর ছাড়াও আশ্রয়ণসহ ৮টি প্রকল্পে দুর্নীতির তথ্য আমলে নেয়া হয়েছে। অন্য প্রকল্পগুলোতে ২১ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে আপনার বিরুদ্ধে। গত ১৯শে আগস্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শেখ হাসিনা পরিবারের দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, আপনি, আপনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক মালয়েশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (আরএনপিপি) থেকে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলার লোপাট করেছেন। বিভিন্ন দেশের সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতির অনুসন্ধানকারী গ্লোবাল ডিফেন্স করপোরেশনের তথ্যের বরাত দিয়ে এসব প্রতিবেদন করা হয়। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটম মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে আপনাকে এ অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেয়। যাতে মধ্যস্থতা করেন সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার সহযোগিতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণে খরচ ধরা হয় এক হাজার ২৬৫ কোটি ডলার। প্রয়োজনের তুলনায় যা অনেক বেশি। যাতে মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এই বাজেট থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের সুযোগ করে দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটম। নিজের ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে এ চুক্তি করেন আপনি। আর এ মধ্যস্থতার বিনিময়ে পাচার করা অর্থের ৩০ শতাংশ পেয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক, শেখ রেহানা ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য।
২০১৩ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে আপনার সাক্ষাতের সময় সঙ্গী ছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক। গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের দাবি, সে সময় ঢাকা-মস্কোর বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তির মধ্যস্থতাও করেন তিনি। ২০০৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া লিমিটেড’ নামে একটি ভুয়া কোম্পানি চালু করেন টিউলিপ সিদ্দিক, তার মা শেখ রেহানা ও চাচা আপনার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী। যুক্তরাষ্ট্রে ‘জুমানা ইনভেস্টমেন্ট’ নামে একটি কোম্পানি রয়েছে তাদের। গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের অভিযোগ, এ কোম্পানির মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশের অফশো’র অ্যাকাউন্টে অর্থ পাচার করতেন আপনি। তাদের এ কোম্পানিটি ডেসটিনি গ্রুপ নামে একটি চিটিং ফান্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার পাচার করে। আপা, এসব খবর পড়ে আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। কেমনে কি হইলো আপা? অবশ্য দুর্নীতি যে আপনার সরকারের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল তা টের পেয়েছে দেশবাসী। কিন্তু আপনি এটা খোলাসা করে গেছেন আপনার শেষ প্রেস ব্রিফিংয়ে। নিজেই বলেছেন, আপনার পিয়ন নাকি ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া সে চলে না। আপনার কথা শিরোধার্য। মনে হচ্ছে দুর্নীতির সঙ্গে আপনিসহ আপনার প্রশাসন এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন যে, নিজেই বলতে বাধ্য হলেন পিয়নের কথা। বাধ্য বললে ভুল হবে। আনন্দেই সেদিন সাংবাদিকদের সে কথা বলেছিলেন। আপনার দপ্তরে থাকা এমন অনেক লোক রয়েছেন যারা কীভাবে হাজার কোটি টাকা অবৈধ উপার্জন করেছেন তার সবই জানেন। এখন একটি শোনা কথা না বললেই নয়, কোনো এক জেলা থেকে এক মুক্তিযোদ্ধা সরাসরি ফোন করেছেন আপনাকে। ওই মুক্তিযোদ্ধা আপনাকে খুব ভালো করেই চেনেন। মুক্তিযোদ্ধা আপনার সঙ্গে দেখা করতে সময় চাইলেন। আপনি সময় দিলেন আপনার কার্যালয়ে সকাল ১১টায়। দিনটি ছিল বুধবার। জেলা শহর থেকে অনেক কষ্টে সময়মতো এসে হাজির হলেন ওই মুক্তিযোদ্ধা। আপনার এপিএসের কাছে বিস্তারিত বললেন। আপনাকে তার আসার খবর পৌঁছানোর কথা সবিনয়ে জানালেন। কিন্তু এপিএস এর কোনো গুরুত্ব দেননি। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা বসে থাকার পর হঠাৎ আপনি বের হলেন রুম থেকে। তাকে দেখেই বললেন, কী ব্যাপার আপনার জন্য আমি ভেতরে বসে আছি। আপনি কখন এসেছেন? মুক্তিযোদ্ধা সেদিন আপনাকে উত্তর দেন সকাল ১১টায় এসেছি। আপনার এপিএসকে বলেছি। তিনি কোনো গুরুত্ব দেননি। তখন আপনি বলে উঠেন, ‘ওহ্ বুঝতে পেরেছি। আপনি ওকে কোনো টাকা পয়সা দেননি। টাকা পয়সা দিলে অনেক আগেই হয়ে যেতো।’ আপনার এ বক্তব্য প্রমাণ করে আপনি নিজে দুর্নীতি করেন এবং আপনার সহযোগীকে দুর্নীতি করার সুযোগ দেন। দুর্নীতির আরেক বরপুত্র এস আলম গ্রুপের সঙ্গে আপনার দহরম মহরম দেশবাসী ভালো করেই জানেন। এই এস আলমে চাকরি করতেন আরেক দুর্নীতিবাজ পি কে হালদার। যার মাধ্যমে এস আলম গ্রুপের মালিক আপনার সঙ্গে সকল লেনদেন সম্পন্ন করতেন। যে কারণে পি কে হালদারের জন্য আপনার গণভবন ছিল সব সময়ের জন্য খোলা। কিন্তু সমস্যা বাধে তখনই যখন পি কে হালদার আলাদা ব্যবসা করতে যান তখনই। এস আলম গ্রুপ তার বিরুদ্ধে লাগে। আপনার সহযোগিতা নেয়। আপনি আর এস আলম গ্রুপ মিলে পি কে হালদারকে ছন্নছাড়া করেছেন। ইতিহাস বলে, ‘বেশি বাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে।’ আপনি কেন গো আপা, এত বাড়তে গেলেন? একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কতো টাকার প্রয়োজন? কতো হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। দুঃখ হয়, নিজের স্বার্থের জন্য দেশটাকে ফোকলা করে গেলেন। আর যদি কিছুটা দিন থাকতেন তাহলে বাংলাদেশ হয়তো বিশ্বে ভিক্ষুকের রাজ্য হিসেবে আখ্যা পেতো। শুধুমাত্র আপনার দুর্নীতিবাজ লোক ছাড়া। তাদের তো আর এদেশে থাকার প্রয়োজন পড়তো না। তাদের জন্য আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া, লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে সেকেন্ড হোম। তারা সেখানে টাকা পাচার করে গেড়ে বসেছেন। বাংলাদেশের দিকে তাদের তাকানোরও প্রয়োজন নেই। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বলে একজন আছেন। তিনি ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না। যেটা আপনার বেলায় হয়েছে। আপনার দলের বেলায় হয়েছে।
ভালো থাকুন আপা।
লেখক