Image description

 মোস্তফা কামাল 

 

আশা-আকাঙ্খা থাকলেও নানা ইস্যুর তোড়ে অলক্ষ্যেই পড়ে থাকছিল স্বাস্থ্যখাত। তা এ বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রেও। নানা ইস্যু ও ঘটনার বাঁকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তের সুপারিশ করে ৫ মে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে এ বিষয়ক সংস্কার কমিশন। এতে মোটাদাগে ৩২টি সুপারিশ করা হয়েছে।

মুখ্য সুপারিশে বলা হয়েছে সংবিধান সংশোধন করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে। পথও বাতলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এই সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য একটি আলাদা ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা আইন’ করতে। যে আইনে  বিনা মূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ব্যাপারে নাগরিকদের অধিকার ও রাষ্ট্রের কর্তব্য নির্ধারণ করা থাকবে। সুপারিশে রোগী সুরক্ষা, আর্থিক বরাদ্দ, জবাবদিহি ও জরুরি অবস্থায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে কিছু নতুন আইনের তাগিদ রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন আইন, বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস আইন, জনস্বাস্থ্য ও অবকাঠামো আইন, বাংলাদেশ সেইফ ফুড, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ ও প্রাপ্তি আইন; স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও রোগী নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি। স্বাস্থ্যখাতে আইনের কিন্তু কমতি নেই। তা অনেকেরই অজানা।

উপরে উল্লেখিতগুলো ছাড়াও অ্যালায়েড হেলথ প্রফেশনাল কাউন্সিল আইন, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক অ্যাক্রেডিটেশন আইন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন, নারী স্বাস্থ্য আইন, ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ আইন, শিশু বিকাশ কেন্দ্র আইন,  বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল আইন, স্বাস্থ্য তথ্য সুরক্ষা আইন, স্বাস্থ্য খাতে টেকসই অর্থায়ন আইনসহ এ খাতের আইনগুলো সম্পর্কে জানা হলো এ ধরনের কতো আইন যে রয়েছে খাতটিতে। ক;জনে জানতেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, মেডিকেল শিক্ষা অ্যাক্রেডিটেশন আইন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল আইন, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল আইন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কথা? এসব আইন সংশোধন করতে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। তাগিদ দেয়া হয়েছে একটি স্বাধীন ও স্থায়ী ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করতে। যে কমিশনটি স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতি প্রণয়নে সংসদ ও সরকারকে কৌশলগত পরামর্শ দেবে।

জাতীয় কৌশল, সেবা ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মানদণ্ড এবং ক্লিনিক্যাল গাইডলাইনও প্রণয়ন করবে। নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কার্যকারিতা, সেবার গুণগত মান ও সার্বিক ব্যয় সাশ্রয় পর্যালোচনা করবে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠনের সুপারিশ করে বলা হয়েছে পেশাদারি, দক্ষতা ও জবাবদিহিমূলক সেবার মান নিশ্চিত করতে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ক্যাডার, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ক্যাডার এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সব জনবল নিয়ে প্রশাসনিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত ও পেশাভিত্তিক একটি নতুন সিভিল সার্ভিস—বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠন করতে হবে। এর সংক্ষিপ্ত নাম হবে  বিএইচএস।

স্বাস্থ্য খাতের জন্য স্বতন্ত্র পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এ কমিশন  স্বাস্থ্য খাতের নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়আসয় দেখবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সর্বজনীন প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সরকারকে এই সেবা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে (ক্ষেত্রবিশেষ ভর্তুকি মূল্যে) দিতে হবে। যাতে কোনো নাগরিক আর্থিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হন। এক কথায় একটি পরিপূর্ণ প্রতিবেদন। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সর্বজনীন প্রাপ্যতাকে একটি মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করার কথাও বাদ যায়নি।

আশা তো করাই যায়, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে দেশের স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনে জেকে বসা সমস্যাগুলো নিরসনে  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশের নামকরা চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান এ কমিশনের লিডার। তিনি ভালো করেই জানে এ খাতটি কোন দশায় চলছে। সেইদৃষ্টে প্রণয়ন করেছেন সুপারিশগুলো। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। যাদের মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে গঠিত সংস্কার কমিশন। কমশিনের প্রতিবেদন ধরে রাখার আগেই এ কমিশনের ব্যাপারে আশায় বুক ভরে গেছে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আজাদ মজুমদারের। উচ্চাশার  পারদ ধরে রাখতে পারেননি তিনি। তাই প্রতিবেদন দেয়ার আগেই উচ্ছাস জানান ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে। যেখানে জানান স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে তার আশার কথা ।  

আবার এ কথাও সত্য  স্বাস্থ্য খাত দেশের সর্বাধিক দুর্দশাগ্রস্ত খাতগুলোর একটি। এ বহুমাত্রিক খাতটির একদিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল। অন্যদিকে ওষুধ এবং তার সহায়ক শিল্প ও চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরির শিল্প। আবার রয়েছে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজসহ বিভিন্ন মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আবার সেবার ধারাও বহুমাত্রিক—অ্যালোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক, আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি। বহু বিস্তৃত এ খাতের পরতে পরতে জমেছে বহুমুখী সমস্যা। স্বাস্থ্য খাতের সমস্যার আরেক কারণ  যত্রতত্র সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ভেঙে দুই টুকরা করা, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা থেকে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি ব্যবস্থাপনা আলাদা করা, বেসরকারি খাতে ব্যাঙের ছাতার মতো ক্লিনিক–ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া। ব্যবস্থাপনা ত্রুটি, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের জন্য মাঠ প্রশাসনকে শক্তিশালী না করা, ওষুধের গুণগত মান রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়াসহ নানা খামখেয়ালিপনা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি স্বাস্থ্যসেবা–ব্যবস্থা অত্যন্ত অবহেলিত এবং প্রহসনের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আবার বেসরকারি খাতে চাকচিক্য থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা মানহীন ও দালালচক্র নিয়ন্ত্রিত।  

 

কে না জানে, দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। তাদের পাঠদান করবেন তারা। দুই যুগ ধরে মেডিকেল শিক্ষায় উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব, শিক্ষা উপকরণের অভাব, উপযুক্ত ল্যাব ও হাসপাতাল না থাকায় শিখনে ঘাটতি, উপযুক্ত হোস্টেলের অভাব এবং লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির দৌরাত্ম্যসহ নানা কারণে তাদের বেশির ভাগ চিকিৎসক হয়ে উঠতে পারেননি। তাদের বড় অংশের কাছে রোগীরা একেকটি যম। পোস্টগ্র্যাজুয়েট, এমবিবিএস, নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টসহ মেডিকেল শিক্ষার সব ক্ষেত্রে গুণগত মান উন্নয়নের সূচক সুখকর নয়। চাইলে জেলার ভেতর তিন বছর পর ট্রান্সফারের বিধান রেখে আগের মতো স্থায়ী নিয়োগেও ফিরে যাওয়া যায়।

লেখক: সাংবাদিক-কলাস্টি, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাশিন।