Image description
বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অবৈধ গাড়ি নিরাপত্তা ও পরিবেশের জন্যও ঝুঁকি। অবাধে চলছে ২৫ বছরের পুরোনো গাড়িও। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েও চলছে ৭৩,০৫৭টি যান।

সড়কে চলতে হলে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, রুট পারমিট ও ট্যাক্সের বৈধ সনদ থাকতে হয়। সারা দেশে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নিবন্ধিত ২০ শ্রেণির প্রায় ৬৩ লাখ ৪৪ হাজার যানবাহন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় ৬ লাখ ৬৫ হাজার গাড়িরই রেজিস্ট্রেশন এবং হালনাগাদ ফিটনেস সার্টিফিকেট, রুট পারমিট ও ট্যাক্স টোকেন নেই। সে হিসাবে প্রতিনিয়ত সড়কে চলা এই বিপুলসংখ্যক গাড়ি অবৈধ। বিআরটিএ বলছে, হিসাবটি চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করার পাশাপাশি এসব গাড়ি দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এবং পরিবেশের ক্ষতি করছে।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, মালিকেরা কাগজপত্র হালনাগাদ না করায় অবৈধ গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গত ২৪ এপ্রিল বিআরটিএ থেকে পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজি) কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন যাতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে, সে জন্য চিঠিতে প্রতিটি অবৈধ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বারও উল্লেখ করা হয়েছে। বিআরটিএ একই চিঠি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে (সওজ) পাঠিয়েছে। চিঠিতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতাধীন সড়ক এবং সেতুতে টোল দেওয়ার সময় অবৈধ গাড়ি চিহ্নিত করে হাইওয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বিআরটিএর কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, সড়কে অবৈধ হয়ে পড়া যানবাহনের মধ্যে বাসের সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার, মিনিবাস ১২ হাজার, ট্রাক সাড়ে ৫৭ হাজার, প্রাইভেট কার ৭৩ হাজার ২০০ এবং মাইক্রোবাস ৩১ হাজার।

দেশে বর্তমানে মোট নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৬৩ লাখ ৪৪ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৪৬ লাখ ৫২ হাজারই মোটরসাইকেল। নিবন্ধিত থাকা ঠিক কতগুলো গাড়ি সড়কে আর চলাচল করে না (‘অফরোড’ হয়ে যাওয়া), সে তথ্য নেই বিআরটিএর কাছে। তবে সংস্থাটি মনে করে, মোট নিবন্ধন করা মোটরযানের প্রায় ৩০ শতাংশ ‘অফরোড’ রয়েছে। সড়কে চালানোর জন্য মোটরসাইকেল ছাড়া সব ধরনের যানবাহনের ফিটনেস সনদ নেওয়া এবং তা প্রতিবছর নবায়ন বাধ্যতামূলক।

অবাধে চলছে ২৫ বছরের পুরোনো গাড়ি

ঢাকা মহানগর এবং এর বাইরের সব সার্কেলেই ২০ এবং ২৫ বছরের পুরোনো ৭৩ হাজার ৫৭টি মোটরযান চলাচল করছে। কোনোভাবেই থামছে না এসব অতি পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় গাড়ির চলাচল। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০ বছরের পুরোনো মোট বাস এবং মিনিবাসের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৭৮২টি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে রয়েছে ৮,১৩২টি এবং মিনিবাস ৬,৪৭৮টি। ২৫ বছরের পুরোনো মোট ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান এবং ট্যাঙ্কার আছে ৩৭,২৫৭টি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে ট্রাক রয়েছে ৫,৯৫৮টি, কাভার্ড ভ্যান ১৪৯টি ও ট্যাঙ্কার ২৮২টি।

সড়ক পরিবহন আইনে যানবাহনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল (ইকোনমিক লাইফ) নির্ধারণের বিষয়ে বলা হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। ২০২৩ সালের মে মাসে বিআরটিএ বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাঙ্কারের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে দেয়। এ-সংক্রান্ত সরকারি ঘোষণায় অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের কথা বলা হয়। কিন্তু বিআরটিএ এটি বাস্তবায়ন তো করতে পারেইনি; উল্টো কয়েক মাস পরই এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহনমালিকদের চাপে বিআরটিএ পিছু হটে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর ক্ষমতায় আসা অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকার ১ মে থেকে এসব বেশি পুরোনো গাড়ি রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু এ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে বেশ হম্বিতম্বি করা হলেও, সে সিদ্ধান্তের দৃশ্যমান বাস্তবায়ন নেই। সড়কে লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি এখনো অবাধে চলছে।

মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পুরোনো মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি ডাম্পিং করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমরা সে কাজটা শুরু করছি।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির ভাষ্য, গাড়ি মালিকেরা সরকারের সঙ্গে একমত। তাঁরা ইতিমধ্যেই প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে বলেছেন, রাস্তায় মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি পেলে ডাম্পিং করতে।

অবৈধ গাড়ি নিয়ে কর্তৃপক্ষের কথা

কাগজপত্র হালনাগাদ না থাকা অবৈধ গাড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক বলেন, ‘আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা সড়কে অবৈধ গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান করছেন। একই সঙ্গে কর্মকর্তাদের জরিমানা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাঁরাও সড়কে অবৈধ গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। পাশাপাশি অবৈধ যানবাহনের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ মহাপরিদর্শকেও আমরা জানিয়েছি।’

সড়ক পরিবহনমালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মো. জোবায়ের মাসুদ বলেন, ‘ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ি সড়কে চলতে পারবে না। মালিকদেরও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁরা যেন দ্রুত কাগজপত্র নবায়ন করিয়ে নেন।’

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধের কৌশল বের করার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পরিবহনমালিকেরা সড়কে কাগজপত্র ছাড়াই গাড়ি চালাতে পারেন। সরকারি কর্তৃপক্ষ বারবার ছাড় দেয় এবং পরিবহনমালিকেরাও ম্যানেজ করে চলেন। এর জন্য বিআরটিএ এবং পরিবহনমালিক উভয়েই দায়ী। অবৈধ গাড়ির সংখ্যা এক দিনে তো ৭ লাখ হয়নি। প্রতিনিয়ত ছাড় দেওয়ার কারণে এ সংখ্যা বেড়েছে। পরিবহনমালিকদের ম্যানেজ করে চলার দুষ্টুচক্র ভাঙতে হবে। তা না পারলে পুলিশকে দায়িত্ব দিয়েও সমাধান হবে না।’