
দুপুর থেকে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। রাজ্জাক চাচা ইন্তেকাল করেছেন বাংলাদেশ সময় বিকেলের দিকে। বিলাতের জীবনে পিতৃস্নেহে যেই দুইজন মানুষ আমাকে আগলে রেখেছেন, উনি তাদের অন্যতম। চাচার সাথে প্রথম দেখা হয়েছে রাজশাহীতে ২০০৩ এর শুরুর দিকে। এর পরে ২০১০ এ আমার শ্বশুর এর বাসায় - উনাদের বন্ধুত্ব ১৯৭৭ সাল থেকে। এরপরে দীর্ঘ বিরতির পরে উনি যখন ইংল্যান্ডে চলে আসলেন, তারপর থেকে নিয়মিতই যোগাযোগ হতো। আনমনে উনার সাথে মেসেজে হওয়া কথাগুলো দেখছিলাম। কত কথা, কত প্ল্যান প্রোগ্রাম। সব এখন অতীত।
২০১৬ সাল থেকে আমরা যখন ফিউচার ইন্সটিটিউট করার পরিকল্পনা করছিলাম, তখন থেকেই চাচার সাথে ঘনিষ্টতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। অনেক হেল্প করতেন, অনেক কথা শেয়ার করতেন। কোন কিছু নিয়ে অভিযোগ করতেন না বললেই চলে। দেশ থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন কয়েক ঘণ্টার নোটিশে। কারও সাথে পরামর্শ করার সুযোগ পাননি। জামায়াতের মত রেজিমেন্টেড সংগঠন, যার সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার বেশি নিজ এলাকার বাইরে থাকতে গেলে অনুমতি নিয়ে যেতে হয়, সেখানে অনুমতি না নিয়ে দেশ ছাড়াটাকে অনেকেই ভাল ভাবে নেন নি। তাছাড়াও নানা কারণে যেভাবে কাজ করতে চাইতেন সেভাবে পারতেন না। আমি উনাকে মাঝে মাঝেই বলতাম- চাচা রাজনীতি ছেড়ে দেন একটা থিঙ্কট্যাঙ্ক দাড় করানোর জন্য। উনি দ্বিধান্বিত ছিলেন। তবে উনি আমাকে অনেক দেশি বিদেশি গুনি মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ফিউচার ইন্সটিটিউটের জন্য।
থিঙ্কট্যাঙ্ক নিয়ে কথা হলে চাচা মাঝে মাঝে আরমান ভাইয়ের (মীর কাশেম আলি চাচার ছেলে) কথা বলতেন। উনার জন্য আফসোস করতেন। আরমান ভাই আর আমান মামাকে (ব্রিগেডিয়ার আজমি) যখন র্যাব গুম করে, উনি সে সময়ে বাংলাদেশ সফরে থাকা আমেরিকান এক সহকারী মন্ত্রীকে নাছোড়বান্দার মত লেগে থেকে ততকালিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে ফোন করান। সেই ফোনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী স্বীকার করেন যে উনাদের দুইজন কে র্যাব তুলে নিয়ে এসেছে। চাচা মাঝে মাঝেই বলতেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গোপনে হলেও একবার যেহেতু স্বীকার করেছে, এই দুইজনকে মারতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর অপার মহিমায় উনারা ফিরে এসেছেন।
২০১৮ সালে আমি চাকরি নিয়ে গ্লাসগো চলে আসি। এর একমাস পরেই ক্যান্সার আক্রান্ত হই। সে কঠিন সময়ে নিয়মিত ফোন করে খোঁজখবর নিতেন। কুরআন থেকে রেফারেন্স দিয়ে সাহস দিতেন। ১৯ সালের প্রথম দিকে (সম্ভবত ফেব্রুয়ারি মাসে) একদিন হটাত ফোন দিয়ে বললেনঃ বাবা, শেষ পর্যন্ত জামায়াত থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কালকে বিবিসি বাংলায় সাক্ষাতকার দিয়ে সেটা পাবলিকলি জানাব। আমি উনাকে বলেছিলাম, পদত্যাগের সিদ্ধান্তের সাথে একমত, তবে যে কারণ দুটো বলছেন সেটা আর মিডিয়ায় যাওয়াটার ব্যাপারে আমার দ্বিমত আছে। কেন দ্বিমত, সেটাও বলেছিলাম। উনি মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। এইটা তার অনেক বড় একটা গুন। সবার কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন।
চাচার সাথে নিঃসঙ্কোচে দ্বিমত করা যেত। উনার এবি পার্টিতে সরাসরি ইনভলভ হওয়াটা আমি পছন্দ করিনি। একদিন একটা ব্যাপারে রেগে যেয়ে একটা মেসেজ পাঠালাম যে এই পার্টি প্রজেক্ট নিশ্চিত ফেইল করবে। উনি একটু পরেই ফোন দিয়ে বললেন কেন ফেল করবে কারণ গুলো বল দেখি, আমি নোট নেই ????
২২ সালের দিকে ইসলামি রাষ্ট্রব্যাবস্থা আর ইসলামি দলগুলো নিয়ে একটা বই লেখা শুরু করেছিলেন। কয়েক চ্যাপ্টারের পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন। এর পরেই উনার শরীর খারাপ হওয়া শুরু হয়। জানিনা বই লেখাটা শেষ করতে পেরেছিলেন কি না। উনি সব সময় বলতেন দেশের জন্য ভাবতে হবে, দেশ না থাকলে দল থাকবে না।
দেশ থেকে আসার পরে চাচা নিয়মিত দেশের সবার খোঁজ নিতেন। আমার ওয়াইফ মোল্লা চাচা আর আজহার চাচার মেয়েদের বান্ধবী হওয়ায় উনি মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে সবার নাম ধরে ধরে জিজ্ঞেস করতেন কার কি খবর। বলতেন আমার সালাম পৌছিয়ে দেবে।
চাচার মধ্যে এক্সিলেন্সের এলেগেন্সের সেন্স প্রবল ছিলেন - বাংলাদেশে ইস্লাম্পন্থিদের মাঝে সেটা একেবারেই অনুপস্থিত। আমি যতদূর জানি বাংলাদেশের ইস্লামিষ্টদের মাঝে তিন জন মাত্র বিলেতে ব্যারিস্টার পদবি ব্যাবহার করতে পারার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। শুধু উনি করেছেন একেবারে নিজের যোগ্যতায়। উনি সবাইকে প্রফেশনাল এক্সেলেন্সের দিকে জোড় দিতে বলতেন।
অসুস্থতার সময়ে যোগাযোগ কম করতাম, সঙ্কোচ হতো। খোঁজখবর নিতাম আযম ভাইয়ের কাছ থেকে। গতবছর হজ্বে যাওয়ার সময় কথা হোল। এর পরে ফেরত এসে দেখা করার কথা বললাম। গত অক্টোবরের ৩ তারিখে চাচার সাথে শেষ দেখা, উনার বার্কিং এর বাসায়। দুর্বল শরীর, কিন্তু দেশের পরিবর্তনে উৎফুল্ল। দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। দোয়া করে দিলেন, ফিউচার ইন্সটিটিউট নিয়ে পরামার্শ দিলেন। প্রফেশনাল এক্সেলেন্সের কথা মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না। বিষণ্ণ মনে বের হলাম। ভাবিনি আর কখনো দেখা হবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উনার গুনাহ মাফ করে জান্নাতুল ফিরদাউসের বাসিন্দা বানিয়ে দিন।
ডঃ ফয়সাল তারিক, ইউকে