
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আলাপের সমান্তরালে জরুরি অবস্থা জারি, শেখ হাসিনার ফিরে আসা, ড. ইউনূসের রিজাইন, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার গ্রেপ্তারসহ গুজবে বাজার গরম। সেই সঙ্গে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ গঠনের শোরগোল। ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ আসবে, না অরিজিনাল আওয়ামী লীগ ফিরবে সেই সিদ্ধান্তই বা কার? আওয়ামী লীগকে ছাড়া ‘ইনক্লুসিভ’ ইলেকশন হবে নাএ তত্ত্বের উদ্ভাবকই বা কে? বলার অপেক্ষা রাখে না, নানান চাপে-তাপে সেদ্ধ দশা যাচ্ছে আওয়ামী লীগে। পাপও কম নয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। কিন্তু দলটির নেতৃত্বের মধ্যে যারা হত্যাসহ মানবাধিকারবিরোধী অপরাধে জড়িত তাদের বিচার হবে এমন অভিপ্রায় জানানোর পর নতুন করে জমেছে বিতর্ক। বিএনপির অবস্থান আওয়ামী লীগ বা কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে। এ ব্যাপারে স্পষ্ট যুক্তি তাদের। জামায়াতসহ ডান-বামের কয়েকটি দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে একাট্টা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কোনো পর্যায় থেকে, সংশোধিত বা রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ গঠন বিষয়ে কথা নেই। তারা ভুল করেছে বা ভুল সংশোধন করতে চায় এখন পর্যন্ত এমন বার্তা দেয়নি। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন থেকে ১৯৯৬ সালে অতীতের ভুলের জন্য দুঃখপ্রকাশ এবং মাত্র একবারের জন্য ক্ষমতা দেওয়ার আবদারের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ কয়েকবার রিফাইন্ড হয়েছে নিজেদের মতো। নিষিদ্ধের প্রশ্ন এসেছে এবারই। রবিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর জানিয়েছেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার করা সম্ভব। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জুলাই হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ ট্রাইব্যুনালের হাতে আছে। তবে, বিচার প্রশ্নে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার। এদিন আদালতে দাখিল করা হয়েছে আশুলিয়ায় হত্যার পর ৬ লাশ পোড়ানোর মামলার তদন্ত রিপোর্ট। জুলাই-আগস্টের গণহত্যা মামলাগুলোর মধ্যে এটিই প্রথম কোনো মামলার তদন্ত রিপোর্ট। ঈদের পর আরও ৩-৪টি মামলার তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে, যার মধ্যে থাকবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলার তদন্ত রিপোর্টও। তথ্য মোটামুটি পরিষ্কার। কিন্তু, এ নিয়ে পরবর্তী অ্যাকশন বা পরিণতি কী?
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বিচার রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদী হামলা ও সামাজিক দাঙ্গার মধ্যে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে গেল জুলাই-আগস্টে। আর্মার্ড কারের ওপর যুবকের লাশ, রিকশার পা-দানিতে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তরুণের আকুতিময় চোখ, হেলিকপ্টার থেকে বাছবিচারহীন গুলিতে শিশুমৃত্যুর ফুটেজ এখনো ভাসছে ভিডিও গেমসের মতো। এরইমধ্যে প্রমাণিত তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার একান্তদের প্রত্যক্ষ নির্দেশেই হত্যা ও আহত করা হয়েছে হাজার-হাজার মানুষ। তখনকার সরকার, প্রধানমন্ত্রী সেইসব অপকর্মের আসামি। দলও দোষী। তা হলে আওয়ামী লীগ নামের দলটির ভবিষ্যৎ কী হবে? দলটির জন্ম পাকিস্তান আমলে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে রিফাইন্ড করতে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে আবার রিমেক-রিফাইন্ডে গোটা দল বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠন। জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুযোগে ’৭৯ সালে স্বনামে ফেরে আওয়ামী লীগ। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে টানা সাড়ে ১৫-১৬ বছরে ভোট তামাশা, গুম-খুন, গণহত্যা, অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এক চরম নিদানকাল পার করছে। নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে ঘুরছে নিষিদ্ধ করার দাবির চক্রবৃত্তে।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় শুধু অপরাধের বিচার নয়, বরং এর সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় জড়িত। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জামায়াতে ইসলামীসহ পাঁচটি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধান অনুযায়ী সব ধরনের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এ সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে আবার কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দেওয়া হয়। এই নিষিদ্ধ ঘোষণার পর কোনো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা, কোনো সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলো থেকে নেতাকর্মীরা জাসদ, ন্যাপ ও আওয়ামী লীগেও যোগ দিয়েছিল। ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার কিছু আগে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু দলটি যে আরও বড় কলেবরে ফিরে এসেছে, তা এখন স্পষ্ট। তবে, আওয়ামী লীগের শাসনের পতন ও তাদের পরিণতির ধরনটা এবার ভিন্ন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এখন পর্যন্ত দলটির নেতাকর্মীদের চিন্তা বা কথায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। অনুশোচনা প্রকাশ করে অনুকম্পা চাওয়ার ইঙ্গিত নেই। কারণ আওয়ামী লীগ গণঅভ্যুত্থান ও তাদের সরকারের পতনকে এখনো একটি ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছে। বিদেশে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দলটির কোনো কোনো নেতার অডিও-ভিডিও এবং স্যোশালমিডিয়ায় দেওয়া বক্তব্যে তা স্পষ্ট। তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার কয়েকটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। এই ফোনালাপগুলো আসল হয়ে থাকলে তার কথাবার্তা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। এসব ফোনালাপে ক্ষোভ ও ক্রোধেরই প্রকাশ ঘটেছে। ফাঁস হওয়া ফোনালাপের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার ফোনের কথাবার্তা এমনই। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকে এখন ভারতে। তাদের একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গে। কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়াও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়, কেউ দিল্লিতে, কেউ আবার ত্রিপুরায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। ইউরোপসহ অন্যান্য দেশেও আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ অবস্থান করছেন। কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় যারা আছেন, নিয়মিত তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়, একে অন্যের বাসায় যান। আর বাংলাদেশে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় মূলত ডিজিটাল মাধ্যমে। আজকের ডিজিটাল যুগে কে কোথায় থাকল, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
শেখ হাসিনাকে অ্যাপের মাধ্যমে মেসেজ করে রাখলে, তিনি তার সময়-মতো উত্তর দেন। আবার নানা সময়ে তাকে ফেসবুক লাইভে আসতেও দেখা গেছে। বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও তিনি যোগ দিয়ে নানা নির্দেশ দেন। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা যত ভাষণ দিয়েছেন, তার সবই অডিওতে। ৫ আগস্টের পর থেকে তার ভিডিও এখনো দেখা যায়নি। তবে, দলের ভেতর বা বাইরে থেকে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার চেষ্টার কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। কেউ কোথাও থেকে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ গঠনের চেষ্টা করছেন এমন তথ্য নিয়েও ধোঁয়াশা। আবার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগও নেই। তা ঘুরছে কেবল দাবিতে। ক্ষমতায় থাকাকালে প্রতিদিনই কিছু না কিছু একটা বলে ট্রল হওয়া সেই সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আজ পর্যন্ত একটি বক্তব্য বা বিবৃতি পাওয়া যায়নি তা আরেক আশ্চর্যের বিষয়। দেশের বাইরে থেকে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার চেষ্টা কতটা কাজে দেবে, সেই প্রশ্নও তাদের মধ্যে রয়েছে। আবার বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বিকল্প নেতৃত্ব দিয়ে দেশের ভেতরে আস্থার সংকট কাটানোর চেষ্টা কতটুকু কাজে দেবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। দলটির মধ্যে এখনো বিকল্প চিন্তারও কোনো ইঙ্গিত নেই। আরেক বাস্তবতা হলো, দলটির লাখ-কোটি কর্মী-সমর্থক সবাই পালায়নি। ভারতে বসে শেখ হাসিনার বক্তব্য, ফোনালাপ, উসকানি বার্তা তাদের দুর্ভোগ-কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যেও বিশাল ভোটব্যাংক দলটির। শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারও নিষিদ্ধের চেয়ে বরং দলটির নেতাকর্মীদের বিচারে আগ্রহী। এখন তা আরও স্পষ্ট। বিএনপির মানসিকতা ও রাজনৈতিক সমীকরণও তাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সংগঠন এনসিপির কিছু নেতাও ধীরে ধীরে বাস্তবতার দিকে আসছেন। নিষিদ্ধের চেয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দুষ্কর্মের বিচার তাদের বেশি কাক্সিক্ষত। সেই বিচার প্রশ্নে প্রথমেই আসে শেখ হাসিনার নাম। কিন্তু, তাকে দেশে এনে বিচার করা সম্ভব কি-না সেটিও এখন পর্যন্ত ক্যাচাল-প্যাচালেই ঘুরছে। ’৮১-তে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা শেখ হাসিনা ঘটনার অনিবার্যতায় ২৪-এ ভারতেই গেছেন। যেখান থেকে আসা, সেখানেই যাওয়া। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন ‘পলাতক শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে যা যা করা দরকার, তাই করা হবে।’ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল আরও আগেই সোজাসিধা জানিয়ে দিয়েছেন, শেখ হাসিনা ভারতে আছেন, ভারতেই থাকবেন। শেখ হাসিনাসহ যারা পালিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন তাদের বিষয়ে আদালতের পরোয়ানা কীভাবে তামিল হবে? এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর করে অনেককেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার’ আদর্শ থেকে সরে এসে ফ্যাসিবাদ কায়েম করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ পাস করে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সরকার কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য কাউকে আটক করতে পারে। এই আইন পাস করে হাজার হাজার প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। ৩৯ বছরের পুরনো ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য পরিচালনার সময় সাক্ষ্যপ্রমাণের অপ্রতুলতার কারণে বিচারকার্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মাত্র ২ মাস পর বিচারকার্য পরিচালনার সময় তথ্য, উপাত্ত, আলামত, সাক্ষ্যপ্রমাণের কোনো অভাব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মনে করার এ স্বাধীনতা থাকা স্বাভাবিক। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার-নিষিদ্ধকরণ নিয়ে নানা কথা চালাচালিও স্বাধীনতা। কিন্তু, বাস্তবতা পুরোটাই রাজনৈতিক। যে যা-ই বলুক, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে রাজনৈতিক সমীকরণে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন