Image description
জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূকৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ

বিগত সরকারগুলোর অনীহা আর আন্তর্জাতিক জটিলতায় আটকে আছে লালমনিরহাট বিমানবন্দরের কার্যক্রম। বিমানবন্দরটি জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূকৌশলগত কারণে দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বেশ কয়েকবার চালুর উদ্যোগ নিলেও নানা কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্প-বাণিজ্য প্রসার এবং ভৌগোলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সব হিসাব-নিকাশ পালটে দিতে পারে এই বিমানবন্দর। এটি চালু হলে চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে আঞ্চলিক হাব হিসাবে গড়ে উঠবে। এতে বাংলাদেশের উন্নয়নে খুলবে উত্তরের দুয়ার। এ অবস্থায় দেশি-বিদেশি চাপ উপক্ষো করে দেশের স্বার্থে এই বিমানবন্দর দ্রুত চালু করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের জেলা লালমনিরহাটে বিমানবন্দরটি প্রায় ৫৪ বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। এর অধিকাংশ জায়গা এখন গোচারণভূমি। অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে বিশাল রানওয়ে। দেখার কেউ নেই। নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিমানবন্দরের ইতিহাস।

জানা গেছে, বিগত সরকারগুলো লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালুর বিষয়ে অনীহা থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বিমানবাহিনী প্রধান লালমনিরহাট বিমানবন্দর পরিদর্শন করে এসেছেন। শিগগিরই সম্ভাব্যতা যাচাই করে ফের কাজ শুরু করার কথা রয়েছে। দেশি-বিদেশি চাপ উপক্ষো করে দেশের স্বার্থে এই বিমানবন্দর দ্রুত চালু হবে এ আশায় বুক বেঁধে আছেন উত্তর জনপদের মানুষগুলো।

গুগল ম্যাপ ও বাংলাদেশসহ পাশ্বর্বর্তী কয়েকটি দেশের মানচিত্র ঘেঁটে দেখা যায়, লালমনিরহাট বিমানবন্দর থেকে ভারতের ‘চিকেন নেক’ খ্যাত শিলিগুড়ি করিডরের দূরুত্ব ১৬০ কিলোমিটার। করিডরটির প্রস্থ মাত্র ২১ কিলোমিটার আর দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার। বিমানবন্দরে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ হবে এই করিডরের গা ঘেঁষে। করিডরের অপর সীমান্তে চীন। আছে ভুটান ও নেপাল সীমান্তও। লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালু হলে চীন, নেপাল, ভুটানের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠবে বাংলাদেশ। ভারতের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব বেড়ে যাবে বংলাদেশের। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ভারত তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে শুরু থেকেই বিমানবন্দরটি চালুর বিরোধিতা করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ভারত তার স্বার্থে লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালু না করতে প্রচ্ছন্ন চাপ দিতেই পারে। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে এটা দেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ব্রিটিশরা সামরিক কৌশলগত কারণে লালমনিরহাটসহ দেশে ৬টি বিমানবন্দর তৈরি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের সেই পরিকল্পনা সফলও হয়েছে। গুরুত্ব থাকলেও দেশভাগের পর এই বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তা আর কেউ মনে করেনি। তিনি বলেন, শিলিগুড়ি করিডরের (চিকেন নেক) কাছে হওয়ায় সামরিক কৌশলগত কারণে বাংলাদেশকে এটি পুনরায় চালুর ক্ষেত্রে ভারতের না বলাটাই স্বাভাবিক। দেশের প্রয়োজনে এই বিমানবন্দরের গুরুত্ব আছে তবে এটি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা কতটুকু তা আগে জানতে হবে।

লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালুর বিষয়ে সর্বশেষ খবর জানতে যোগাযোগ করা হয় বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহানের সঙ্গে। তবে তিনি এ বিষয়ে এখনই কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। লালমনিরহাট বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৯৩১ সালে লালমনিরহাট বিমানবন্দর নির্মাণ করে। লালমনিরহাট সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর ও হারাটি এলাকায় ১১৬৬ একর জমির ওপর নির্মিত হয় বিমানবন্দর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই বিমানবন্দরটি মিত্রবাহিনী ব্যবহার করে। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আর ব্যবহার হয়নি। ১৯৫৮ সালে স্বল্প পরিসরে বিমান সার্ভিস চালু ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনী এখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এটিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেডকোয়ার্টার করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০২০ সালের ১৯ জুলাই সেনাবাহিনীর পাইলট ট্রেনিং একাডেমির হেড কোয়ার্টার ঢাকা হতে লালমনিরহাটে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে লালমনিরহাট বিমানবন্দরের পাশেই অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। বিমান চালনা, নির্মাণ ও মেরামত এবং মহাকাশ প্রযুক্তিতে বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। গড়ে উঠবে বিমান নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চললেও চার কিলোমিটারের দীর্ঘতম রানওয়ে, বিশাল টারমাক, হ্যাঙ্গার, ট্যাক্সিওয়ে এগুলো সবই এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। বড় বড় বিমান অবতরণের জন্য উপযোগী রানওয়ে ফেলে রেখে নষ্ট করা হচ্ছে। দীর্ঘ ৫ দশকেরও অধিক সময় ধরে পড়ে থাকা লালমনিরহাট বিমানবন্দর পুনরায় চালু দেখতে অপেক্ষায় আছেন রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভুটান ও নেপালের মানুষ।

জানা যায়, সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের শ্বাসনালি করিডর হলো ‘চিকেন নেক’। এর আশপাশেই রয়েছে চারটি দেশের সীমানা। বাংলাদেশ, চীন, নেপাল ও ভুটান। বিশ্লেষকদের মতে, এই করিডর হাতছাড়া হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে দেশটির ৭টি রাজ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। লালমিনরহাট বিমানবন্দর চালু হলে দেশি এবং আন্তর্জাতিক বিমানগুলো এই ‘চিনেক নেক’র পাশ দিয়ে উড়াউড়ি করবে। বিমানবন্দরটি চীনের ব্যবহার ভারতের নিরাপত্তা শঙ্কা বাড়িয়ে তুলবে। ফলে কোনোভাবেই এটি পুনরায় চালু হোক তা চায় না ভারত। ‘চিকেন নেক’ ইস্যুতে চীন এবং ভারত উভয়ই বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার জোরালো চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এখানেই শেষ নয়। লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালু হলে ভূ-রাজনীতিতে বেশ মোড়লপনা করতে পারবে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব বহন করবে এটি। সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার ট্রাম্পকার্ড হয়ে উঠবে এই বিমানবন্দর।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি পুনরায় নির্মাণ আমাদের অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে। বিমানবাহিনী প্রধানসহ সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে অবহিত আছেন। কোনো দেশের সুবিধা-অসুবিধা দেখে নয়, আমাদের দেশের প্রয়োজনেই এই বিমানবন্দরটি চালু হবে।

বিষয়টি নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে বিস্তর কথা বলেন বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদ সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম। তার মতে, ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে বর্তমান সরকারের উচিত লালমিনরহাট বিমানবন্দরটি চালু করা। কে কোন হুমকি দিল তা তোয়াক্কা করার সময় নেই। আমাদের দেখতে হবে এই বিমানবন্দরটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ এই বিমানবন্দরটির বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এটি অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি নেপাল, ভুটানসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও গুরুত্ব বহন করে। বিমানবন্দরটি ব্যবহারে নেপাল ও ভুটান প্রস্তাবও দিয়েছে। চালু হলে বাংলাদেশের পাশ্বর্বর্তী চারটি দেশ-চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে আঞ্চলিক হাব হিসাবে গড়ে ওঠবে এই বিমানবন্দর। এছাড়া উত্তরাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে কৃষিপণ্য উৎপাদন হয়। এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে এসব পণ্য দেশের সর্বত্র সরবরাহ করা গেলে দেশের কৃষি বাজারে ভারসাম্য গড়ে উঠবে। বিদেশে রপ্তানিও সহজ হবে। অল্প কিছু সংস্কার করে এই বিমানবন্দরটি চালু করা সম্ভব।

ওয়াহিদুল আলম আরও বলেন, ভারতের ‘চিকেনস নেক’র কাছাকাছি হওয়ায় ভারতের আপত্তি বা ভয় থাকতেই পারে। তাই বলে এটি চালু করব না তা তো হতে পারে না। তাছাড়া ভারতের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো চুক্তি বা আইন নেই। আমি সরকারকে বলব, যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিল করে বিমানবন্দরটি চালু করা হোক।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচএম রাকিব হায়দার যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে বিমানবন্দর নিয়ে আপডেট নেই। তবে সম্প্রতি বিমানবাহিনী প্রধান এসেছিলেন। দ্রুতই পদক্ষেপ নেবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। সরকারি পর্যায়ে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। তিনি বলেন, লালমনিরহাট বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তা অনেক। এটি চালু হলে চিলমারীর বন্দর থেকে শুরু করে এ অঞ্চলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। স্বল্প সময়ে মানুষ ঢাকা যেতে পারবে। ভূরাজনীতির দিক দিয়ে এই বিমানবন্দর হবে দক্ষিণ এশিয়ার বিজনেস হাব। পার্শ্ববর্তী চারটি দেশের যোগাযোগ হবে এই বিমানবন্দর দিয়ে। এখানকার অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা বেড়ে যাবে বহুগুণ।

দেশি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লালমনিরহাট বিমানবন্দর কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে কথা হয় একাধিক বিমানবন্দর ও ভূ-রাজনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। তারা সবাই প্রায় একই সুরে যুগান্তরকে বলেন, এই বিমানবন্দর চালু হলে আঞ্চলিক হাব হিসাবে গড়ে উঠবে বাংলাদেশ। তাদের মতে, ভারতের বাগডোগরা বিমানবন্দর রাতে ব্যবহারে সমস্যা। এছাড়া বাগডোগরায় যে বিমান নামতে পারবে না সেগুলো লালমনিরহাট বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। আবহাওয়া খারাপ হলে বা কারিগরি সমস্যা হলে এই অঞ্চলে উড্ডয়নকৃত বিমান পাঠানো হয় হাজার মাইল দূরের দিল্লি বিমানবন্দরে। সেক্ষেত্রে ভুটান এই সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে লালমনিরহাট বিমানবন্দরে। নেপালের বিরাগনগর থেকে লালমনিরহাট বিমানবন্দরের ফ্লাইং টাইম মাত্র ২৫ মিনিট। এ বিমানবন্দর তারা ব্যবহার করতে পারলে যোগাযোগ সহজ হবে। ভারতের সেভেন সিস্টার হিসাবে পরিচিত সাত রাজ্যসহ আশপাশের আরও কয়েকটি রাজ্য, নেপাল এবং ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ তৈরির একটা অন্যতম মাধ্যম হতে পারে লালমনিরহাট বিমানবন্দর। লালমনিরহাট হয়ে উঠবে ‘গেটওয়ে টু নর্থ-ইস্ট’ এবং ‘মাউথ অব আসাম’। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বাংলাদেশের উত্তরের এই জনপদ। সার্বিক বিবেচনায় বিমানবন্দরটি চালু হলে রংপুর অঞ্চলে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটবে। সুযোগ তৈরি হবে নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। এছাড়াও লালমনিরহাটের বুড়িমারি স্থলবন্দর, কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর, চিলমারি নদীবন্দর আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে সরকারি কোষাগারে জমা হবে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব, তেমনি এলাকার জনগণও লাভবান হবে। তাই এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি পুনরায় চালুর দাবি জানান রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।