Image description

বদরুল আলম নাবিল

রাষ্ট্রক্ষমতার ব্যবহারে গঠিত দলকে রাজনীতিতে ‘কিংস পার্টি’ বলা হয়। সমপ্রতি আত্মপ্রকাশ করা দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই ‘কিংস পার্টি’র তকমা পেয়েছে। দলটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন বিএনপি’র জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। যদিও তিনি দুই মাসেরও বেশি আগে গত বছরের ২৬শে ডিসেম্বর খোলাখুলি অভিযোগ করেছেন, নতুন দল গঠনে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সেদিন তিনি বলেন ‘আগামী সংসদে কারা নির্বাচিত হবে, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি তা নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে জুলাই আত্মত্যাগের কী দাম থাকবে?’ ‘বিএনপিকে ভাঙার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ক্ষীণ প্রচেষ্টা কাজ করছে কি-না, তা নিয়ে জনগণের ভেতরে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।’ এমন গুরুতর অভিযোগও করেন রিজভী।
সবশেষ ২৮শে ফেব্রুয়ারি দলটি ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর কোনোরকম রাখঢাক না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, ‘গণহত্যার বিচার ও রাষ্ট্র সংস্কার না করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ‘কিংস পার্টি’র আত্মপ্রকাশ। পরের দিন জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করেন, জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আগ্রহীদের জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে গাড়ি রিকিউজিশন করার মতো বিষয় দেখা গেছে। গাড়ি সরবরাহে মালিক সমিতি ও পরিবহন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
নুরুল হকের দাবি, আন্দোলনকেন্দ্রিক পরিচিত ছাত্রনেতাদের তদবির, নিয়োগ, টেন্ডার-বাণিজ্যসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অসংখ্য ঘটনা ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। 


সরকারে থাকা তিন ছাত্র উপদেষ্টার মধ্যে একজন পদত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন উল্লেখ করে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি বলেন, ‘সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ও জনগণসহ রাজনৈতিক নেতাদের আস্থা ধরে রাখতে সরকারে থাকা অন্য দুই ছাত্র উপদেষ্টাসহ সরকারে প্রতিনিধিত্বকারী সব ছাত্রের পদত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছি।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আক্তার হোসেনসহ নেতৃত্বস্থানীয় অনেকেই এক সময় নুরুল হকের ছাত্র অধিকার পরিষদ করেছেন। 
এনসিপি এখনো তাদের সাবেক নেতার অভিযোগের জবাব দেয়নি; তবে কিংস পার্টির তকমা নিয়ে বিএনপি’র সঙ্গে বাহাস চলছে সেই ডিসেম্বর থেকেই। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় মদতে নতুন এই রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। ছাত্রনেতারা এ ভাষ্য নাকচ করে বিএনপিকে উল্টো সফল ‘কিংস পার্টি’ বলছেন।


পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনে ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল প্রেসিডেন্ট হন জিয়াউর রহমান। ওই বছরই গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল)। এটিসহ ছয়দলীয় জোট জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পরের বছরের ৩রা জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান। এর তিন মাসের মাথায় তার নেতৃত্বে গঠিত হয় বিএনপি।
১৯৭৮ এর সেই ইতিহাস উল্লেখ করে নতুন দলটির নেতারা উল্টো বিএনপিকে কিংস পার্টি বলছে। জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপিকে ‘কিংস পার্টি’ বলে আখ্যা দেন। আর সামান্তা শারমীন বলেন, ‘বাংলাদেশে সবচেয়ে সফল কিংস পার্টি হলো বিএনপি।’


এ তকমার জবাবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদ্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘বিএনপির বয়স এখন ৪০ বছরের বেশি। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। প্রত্যেকের রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার রয়েছে। নতুন দলকে স্বাগত জানায় বিএনপি। তবে দেখতে হবে, সেই দল জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে কিনা।’
জাতীয় পার্টিও রাষ্ট্রক্ষমতার ব্যবহারে গঠিত হয়েছিল। ক্ষমতায় থেকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালে গঠন করেন জাতীয় পার্টি। এতে আবদুল মতিনের নেতৃত্বে বিএনপি’র একাংশ এবং মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একাংশ এতে যোগ দেয়। ভাগিয়ে আনা হয় অন্যান্য দলের নেতাদেরও।
এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আরও অসংখ্য কিংস পার্টি গঠনের চেষ্টা দেখা গেছে, কিন্তু সেগুলোর কোনোটিই রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেনি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থনে বিগত নির্বাচনের আগে বিএনএম (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন) এবং তৃণমূল বিএনপি তৈরি হয়। এই দু’দলে বিএনপি নেতাদের ভাগিয়ে নিতে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার চাপ ও প্রলোভন ছিল। এর আগে তৈরি হয়েছিল বিএনএফ (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট)।


সেনাসমর্থিত এক-এগারোর সরকারের সময় পিডিপি (প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি) গঠনের প্রকাশ্য প্রচেষ্টা ছিল। এতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়। 
জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা গত বছর ৮ই সেপ্টেম্বর গঠন করেন জাতীয় নাগরিক কমিটি নামের প্ল্যাটফরম। সেটি এখনো বিলুপ্ত করা না হলেও সেই প্ল্যাটফরমের সব নেতারাই এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা। গণঅধিকার পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কয়েকজন নেতাও যুক্ত হয়েছেন দলটিতে। গণঅধিকার পরিষদ অভিযোগ করেছে রাষ্ট্রীয় মদতে অর্থবিত্ত আর এমপি-মন্ত্রী বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ভাগানো হয়েছে।  


নবগঠিত দলটি গোয়েন্দা সংস্থা এবং রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে কিনা তা এখনো স্পষ্ট না হলেও ব্যয়বহুল আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান, রাজধানীর একটি আধুনিক ভবনে জাঁকজমকপূর্ণ কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এতসব বিপুল খরচের অর্থের উৎস কী? এমন প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই সামনে এসেছে। যেখানে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম নিজে জানিয়েছেন তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র ১০ হাজার ৬৯৮ টাকা আছে। সংগঠনের অন্যসব নেতাও বয়সে তরুণ, কেউ সদ্য শিক্ষা জীবন শেষ করেছেন, অনেকে এখনো ছাত্র। এসব থেকে প্রশ্ন এসেছে এই দলের পেছনে কোন শক্তি আছে। তবে কোন সে শক্তি? সরকার না অন্য কেউ তা এখনো স্পষ্ট নয়। 


এদিকে দলটির নেতারা অভ্যুত্থানের পর থেকেই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছেন। তার মধ্যে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি ছাড়া বাকি সব সংস্কারের কথা বিএনপি’র ৩১ দফায়ও রয়েছে। সে কারণেই হয়তো বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে সবাই অনেক ভালো ভালো কথা বললেও রাষ্ট্র সম্পর্কে কোনো পলিটিক্যাল ফিলোসফি (রাজনৈতিক দর্শন) পাইনি।’


অন্যদিকে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলগুলোর মধ্যে যেমন পদ-পদবি এবং ফটোসেশনের সময় কে কোথায় দাঁড়াবে তা নিয়ে যে তীব্র প্রতিযোগিতা হয় নতুন এই দলটিও তার থেকে মোটেই বের হতে পারেনি। দলটির ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে পদ-পদবি নিয়ে রীতিমতো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিন এলাকা। আর মূল দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের পাশে দাঁড়ানো নিয়েও ঠেলাঠেলি করতে দেখা গেছে শীর্ষ নেতাদের। 
এ অবস্থায় ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা করা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ভবিষ্যৎ কী তা সময়ই বলে দিবে। 


লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক