Image description
 

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সফর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জাতিসংঘের নৈতিক সমর্থনের ইঙ্গিত দিয়েছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে এবং গণতন্ত্র ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বার্তা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের মতে, প্রতিবেশীসহ বেশ কিছু দেশের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের শীতল সম্পর্কের সময়ে জাতিসংঘ দূতের এ সফর বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্ব বহন করছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে চারদিনের সফরে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে আসেন জাতিসংঘ মহাসচিব। গতকাল সকাল ১০টায় তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। সফরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন তিনি ব্যস্ততম সময় পার করেছেন। শুক্রবার তিনি প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। এদিন তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান।

রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে ফেরত যেতে চান বলে জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানান। যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক সহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় উদ্বেগও প্রকাশ করে জাতিসংঘ দূত। মানবিক সহায়তা কমে গেলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। তিনি সহায়তা অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা বৃদ্ধির জন্য তার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

শনিবার জাতিসংঘ মহাসচিব ঢাকায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে একটি গোলটেবিল বৈঠক, বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক এবং তরুণ ও সুশীলসমাজের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। পরে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেন।

সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। বাংলাদেশ জাতিসংঘকে বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে পাশে পাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শান্তি, জাতীয় সংলাপ, পারস্পরিক বিশ্বাস ও স্থিরতা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে জাতিসংঘ প্রস্তুত রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ দেশের জনগণ বৃহত্তর গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে। জাতিসংঘও এর স্বীকৃতি দিচ্ছে বলে তিনি জানান। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন পৃথিবীতে নজির সৃষ্টি করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের জাতিসংঘ মহাসচিবের সর্বাত্মক সহায়তা থাকবে বলেও যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানান।

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গুতেরেস বাংলাদেশ মিয়ানমার মানবিক করিডোর নিয়ে বলেন, মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। এ কারণেই যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বাংলাদেশকে চ্যানেল বা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে যথাযথ অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

জাতিসংঘ মহাসচিবের অন্তর্বর্তী সরকার এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত অর্থবহ বলে শনিবার যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা, অধিকার নিশ্চিত করে ফেরত পাঠাতে চাই। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের সহায়তা কাম্য। জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণের জন্য পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেছেন।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আন্তোনিও গুতেরেস আমাদের সফল সংস্কার প্রক্রিয়া ও গণতন্ত্রে উত্তরণে সহায়তা করবেন। একই সঙ্গে তিনি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশের প্রকৃত রূপান্তরের জন্য সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রশংসা করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা করবেন এবং বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকবেন বলেও জাতিসংঘ মহাসচিব আশ্বাস দিয়েছেন।

জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরকে সফল বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এম হুমায়ুন কবির। দৈনিক আমার দেশ-এর সঙ্গে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর সরকারের প্রতি সংস্থাটির জোরালো সমর্থনের বার্তা দিয়েছে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সফরটি ইতিবাচক উল্লেখ করে সাবেক দূত হুমায়ুন কবির বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলেছেন। সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। এটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝা উল্লেখ করে সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে তাদের কথা শুনেছেন। তারা নিজভূমিতে ফেরত যেতে চান এই বার্তাটি তিনি শুনছেন। আমি মনে করি, তার এই সফর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে একটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সহায়তা কমে গেলে কোন ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তার একটি বার্তা দিয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিষয়টির জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। আমি মনে করি, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন।

মানবিক করিডোরের বিষয়টিকে সবার ইতিবাচক নেওয়া উচিত উল্লেখ করে হুমায়ুন কবির বলেন, আমি করে করি এই বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে চিন্তা করা উচিত। এটা সম্ভব হলে তিন পক্ষের মধ্যে একটি আস্থার জায়গা তৈরি করে। যেটা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আমার দেশকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সময় আমাদের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক সহায়তা কাটছাঁট করেছে সেই সময় জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মনে করি। মহাসচিব এই সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান করেছেন। তিনি তার ব্যক্তিগত প্রভাব এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে ভেটো প্রদানকারী সদস্যদের মাধ্যমে এই সহায়তা আরো বাড়াতে পারেন তাহলে একটা বড় কাজ হবে। অবশ্য এটা কতটা সম্ভব সেটা এখনই বলা মুশকিল। এজন্য হয়তো আমাদের আরো দুয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের আশ্বাস প্রশ্নে সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের খুবই একটা ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। এই সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। আরাকানদের সঙ্গে আমাদের সরকারকে কথা বলতে হবে। তবে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে রোহিঙ্গারা যে দেশে ফিরতে চাওয়ার যে ইচ্ছা পোষণ করেছেন এটা ইতিবাচক বিষয় বলতে পারি।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র উত্তরণে জাতিসংঘের সহায়তার আশ্বাস খুব একটা কাজে দেবে বলে করে করেন না অধ্যাপক ইমতিয়াজ। তিনি বলেন, জাতিসংঘ আগেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করতে এসে সেটাকে আরো জটিল করেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। এত বড় একটা বিপ্লব আমাদের ছেলেরা করে ফেলেছে। আমরা কেন এখন সমাধান করতে পারব না। হয়তো একটু দেরি হবে। তবে বিশ্বাস করি, আমরাই সমাধান করতে পারব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গাদের সহায়তায় অর্ধেক কমে যাওয়ার পর জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর আশার ক্ষীণ আলো তৈরি করেছে। বাংলাদেশও জাতিসংঘ দূতের মাধ্যমে একটা চেষ্টা চালানোর সুযোগ পেয়েছে। এই সফর সহায়তা বাড়াতে কতটা কাজে দেবে সেটা বলতে পারছি না। তবে আশার জায়গা তৈরি করেছে। এজন্য এ সফরকে সরকারের টোকেন সফলতা বলতে পারি।

তিনি বলেন, জাতিসংঘ বরাবরই বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়নের পক্ষে কাজ করে চলেছে। বর্তমান সরকার যে সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে তার প্রতি জাতিসংঘের সহায়তার অর্থ তারা সরকারকেই সমর্থন করছে।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব দেওয়ার পর বেশ কিছু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের নতুন মাত্রা পেয়েছে এমনটাও আমরা দেখছি না। এই সময়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর সরকারের জন্য আশার আলো দেখিয়েছে। এতে করে সরকারের মধ্যে নৈতিকভাবে কিছুটা হলেও শক্তির সঞ্চার হয়েছে।