Image description
‘যদি চলেও যাই, কোন আক্ষেপ নিয়ে যাব না’
২৯ আগস্ট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন শহীদ শাফি ইমাম রুমীকে আটক করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি নরপশুরা। সেই ভয়ার্ত বর্ণনা ফুটে উঠেছে রুমীর মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে। একইসঙ্গে ফুটে উঠেছে শহীদ জননীর মাতৃস্নেহ। মুক্তির জন্য রুমীর আত্মত্যাগের বর্ণনা আর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি থেকে রুমীকে তুলে ধরেছেন নিউজরুম এডিটর আবু তালহা ঢাকা: ‘আমি কোনো দলভুক্ত নই, কোনো রাজনৈতিক দলের স্লোগান বয়ে বেড়াই না। কিন্তু আমি সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন, মান-অপমান জ্ঞানসম্পন্ন একজন সচেতন মানুষ।’ এ ধরনের মুক্ত চেতনা এবং দেশপ্রেম থেকেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন শাফি ইমাম রুমী। ২০ বছর বয়সী যুবক অবলীলায় মায়ের অনুমতি চান যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। শহীদ রুমীর বীরত্বগাথা পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে পরে মৃত্যুবরণকারী শরীফ ইমাম ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে শাফি ইমাম রুমী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন গেরিলা যোদ্ধা। তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে সুযোগ পেলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর আদর্শগত কারণে দেশকে যুদ্ধের মধ্যে রেখে বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে নিজের ক্যারিয়ারের জন্য পড়তে যাননি। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে রুমী ধারাবাহিকভাবে তার মা ও বাবাকে নিজের যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মাকে অবশেষে রাজি করিয়ে ২ মে রুমী সীমান্ত অতিক্রমের প্রথম প্রয়াস চালান। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাকে ফেরত আসতে হয় এবং দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সফল হন। তিনি সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ সেক্টরটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও রশিদ হায়দার। প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ঢাকায় ফেরত আসেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী সংগঠন ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেন। রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে হামলা করা। এ সময় তাকে ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয় যার মধ্যে ধানমণ্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ধানমণ্ডি রোডের অপারেশনের পর রুমী তার সহকর্মীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি তার নিজের বাড়িতে কাটান। কিন্তু ওই রাতেই বেশকিছু গেরিলা যোদ্ধার সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একটি অজ্ঞাত উৎস থেকে তথ্য নিয়ে বেশ কিছু গেরিলা যোদ্ধাকে গ্রেফতার করে যার মধ্যে ছিলেন আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক, আজাদ ও জুয়েল। রুমীর সঙ্গে তার বাবা শরীফ ইমাম এবং ভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের স্থানে রুমীকে ভাই ও বাবাসহ একঘরে আনলে রুমী সবাইকে তার যুদ্ধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন এবং এর সব দায়-দায়িত্ব তিনি নিজেই নিতে চান। ৩০ আগস্টের পর রুমী ও তার সহযোদ্ধা বদি এবং চুল্লুকে আর দেখা যায়নি। ইয়াহিয়া খান ৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলে অনেক আত্মীয় তার জন্য আবেদন করতে বলেন। কিন্তু রুমী যে বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ধরা পড়েছেন, তাদের কাছেই ক্ষমা চাইতে রুমীর বাবা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী, দেশপ্রেমিক শরীফ ইমাম রাজি হননি। ন্যায়বিচার পেয়েছে শহীদ রুমীর আত্মা ৪২ বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, শহীদ রুমীসহ তার সহযোদ্ধাদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আলবদর সদস্যদের সহায়তায় আটক করে নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলের ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করে। পরে তাদের লাশ গুম করে ফেলা হয়। এ নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত তখনকার আলবদর কমান্ডার জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। রুমীদের হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত অপর আলবদর কমান্ডার জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায় অপেক্ষমাণ রয়েছে। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ট্রাইবুনাল-২ এর রায়ে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, রুমী হত্যা ও নির্যাতনসহ উত্থাপিত ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টিতে দোষী প্রমানিত হন। এর মাঝে দু’টি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। রুমীদের হত্যার দায়ে পৃথকভাবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন তিনি। শহীদ জননী একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ে যা লিখেছেন ৯ এপ্রিল। রুমী খুব আস্তে কিন্তু দৃঢ় গলায় বলে, ‘আম্মা। আমি যুদ্ধে যেতে চাই।’ মায়ের মন কেঁপে ওঠে। “কিন্তু যুদ্ধটা কোথায়? কেউ তো ঠিক করে বলতে পারছে না। সবখানে শুধু জল্লাদের নৃশংস হত্যার উল্লাস-হাতবাঁধা, চোখবাঁধা অসহায় নিরীহ জনগণের ওপর হায়েনাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার নিষ্ঠুর মত্ততা।” ১ মে। “চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা লোকজনকে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, নদীতে চোখ-হাত বাঁধা বুলেটবিদ্ধ লাশ ভেসে যাওয়া-এসব খবরের পাশাপাশি আরেকটা রক্ত হিম-করা খবরও মাঝে-মাঝে শুনছিলাম। পাকিস্তান আর্মি যুবা ও বয়স্ক লোকদের ধরে নিয়ে এখন আর গুলি করে মেরে ফেলছে না, তাদের শরীর থেকে শেষ বিন্দু পর্যন্ত রক্ত বের করে নিয়ে তারপর লাশ ফেলে দিচ্ছে। আমার ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না।” রুমী রেগে ওঠে, ‘আম্মা সবটাতেই তোমার অবিশ্বাস। সবকিছুতেই তোমার প্রমাণ চাই। কেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী কি করেছে কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে বন্দিদের ওপর, পড় নি?’ রাজধানী জুড়ে শুরু হয় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ। ৮ আগস্ট। গতকাল সন্ধ্যার পর ফার্মগেটের মিলিটারি চেকপোস্টে গেরিলা অপারেশন। ফার্মগেটের মিলিটারি চেকপোস্টটা বেশ বড়সড়। ওখানকার ট্রাফিক আয়ল্যান্ডের মধ্যখানে দুটো তাঁবুতে অনেকগুলো মিলিটারি পুলিশ। কাছাকাছি ফুটপাতে লাইট মেশিনগান হাতে মিলিটারি। একটু দূরে গ্রীন রোডে ঢোকার মুখে মোড়ে একটা সিনেমা হল তৈরি হচ্ছে, সেটার মাথাতেও লাইট মেশিনগান হাতে এক মিলিটারি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এলাহি ব্যাপার-স্যাপার। এই রকম মারাত্মক বিপজ্জনক জায়গায় বিচ্ছুরা যে কাণ্ডটি করল, সেটাও এলাহি কাণ্ড-কারখানাই বটে। ৫০ দিন পর রুমী এসে ঢুকল ঘরে। রুমীর মুখভর্তি দড়ি, চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা, তামাটে গায়ের রঙ রোদে পুড়ে কালচে, দুই চোখে উজ্জ্বল ঝকঝকে দৃষ্টি, গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে ফুটে রয়েছে সেই ভুবন ভোলানো হাসি। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় গোল হয়ে বসে শুরু হয় গল্প। রুমী বলেন, ‘মেলাঘরে গিয়ে দেখি- ঢাকার যত কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা, ধানমণ্ডি-গুলশানের বড়লোক বাপের গাড়ি হাঁকানো ছেলেরা, খেলার মাঠের চৌকস ছেলেরা, ছাপোষা চাকুরে বাপের ছেলেরা সব্বাই ওখানে জড়ো হয়েছে।’ খানিক পরে একটু উসখুস করে রুমী বলল, ‘আম্মা, আমি কিন্তু সিগারেট ধ’রে ফেলেছি। তোমাকে প্রমিস করেছিলাম না, যে ধরবার আগে জানাব? তা আর হলো না।’ মনে পড়ল, রুমী যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখনই বলেছিলাম, দ্যাখ, সিগারেট যদি ধরিস তো বলে-কয়ে ধরবি। নইলে লুকিয়ে সিগারেট খাবি, আমি জানব না, তারপর আমার বান্ধবী এসে বলবে, রুমীকে সিগারেট খেতে দেখলাম- সে আমার সইবে না। রুমী বলেছিল, ‘আম্মা, আব্বু যখন খায় না, খুব সম্ভব আমিও ধরব না। তবে যদি ধরিই, অবশ্য তোমাকে আগে জানাব।’ এখন রুমী হাসতে হাসতে বলল, ‘ওখানে সিগারেট না ধরে উপায় নেই আম্মা। খাওয়া-দাওয়ার কোন ঠিক-ঠিকানা থাকে না অ্যাকশানে গেলে, অনেক সময় না খেয়েও থাকতে হয়, কাছে-ভিতে কোন খাবারই জোটে না। এই সিগারেটটাই একমাত্র জিনিস, যা সঙ্গে রাখা যায়। আম্মা, তোমাদের সামনে খাব, না আড়ালে যাব।’ এখন ধরা গলায় বললাম, ‘না, সামনেই খা। অল্প ক’দিনের জন্য এসেছিস। সিগারেট খাবার সময়টুকুও তোকে চোখের আড়াল করতে চাই নে।’ মেলাঘর: ‘গ্রামও না, আধাশহরও না, একেবারে পাহাড়ী জঙ্গুলে জায়গা। টিলার ওপরে বেড়ার ঘরে, তাঁবুতে আমরা সবাই থাকি। খাওয়া-দাওয়ার কথা আর জিগ্যেস করো না। ওইটার কষ্টই সবচেয়ে বেশি। ভাত আর ডাল। কখনো লাবড়া, কখনও মাছ। সকালের নাশতা রুটি আর ঘোড়ার ডাল। জানো আম্মা, কতোদিন সে রুটির মধ্যে সেঁকা পোকা পেয়েছি। সেঁকা পোকাটা নখে খুঁটে ফেলে দিয়ে রুটি খেয়ে নিতাম।’ এই রুমী! যে প্লেট বা গ্লাস আমার চোখে ঝকঝরে পরিষ্কার মনে হত, তার মধ্যেও সে এককণা ময়লা আবিষ্কার করে ফেলত। ১৫ আগস্ট। ক’দিন থেকে সময় পেলেই বিভিন্ন দোকানে একটা জিনিস খুঁজে বেড়াচ্ছি- ওয়াটার প্রুফ সিগারেট কেস। রুমী বলেছিল, আম্মা দেখো তো এমন একটা সিগারেট কেস পাও কি না, যেটার ডালা খুব চেপে লেগে থাকে। মানে পানিতে পড়লে যাবে পানি না ঢোকে। আমাদের না, অ্যাকশানে গেলে পাক আর্মি বা রাজাকারদের তাড়া খেয়ে অনেক সময় দৌড়ে পালাতে হয়। কখনো পুকুরে বা নদীতে ঝাঁপ দিতে হয়। তখন সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই ভিজে গেলে বড্ডো কষ্ট হয়।’ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া সেনারা দেশের জন্য শহীদ হতেই গিয়েছিলেন। ২১ আগস্ট। রুমী বলেছিল ‘আমাদের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফ কি বলেন, জান? তিনি বলেন, কোন স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না; চায় রক্ত-স্নাত শহীদ। অতএব মা মণি, আমরা সবাই শহীদ হয়ে যাব- একথা ভেবে মনকে তৈরি করেই এসেছি।’ ২৮ আগস্ট। টম জোনসের ‘গ্রীন গ্রীন গ্রাস’। রুমী এটা প্রায়ই বাজায়। ইংরেজি গানের কথা বিশেষ বুঝি না। তিন মিনিটের গানটা শেষ হলে রুমী আস্তে আস্তে বলল, গানটার অর্থ এক ফাঁসির আসামী তার সেলের ভেতর ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল সে তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছে। সে ট্রেন থেকে নেমেই দেখে তার ভালো লাগল তার মা-বাবাকে দেখে, তার প্রেয়সী মেরীকে দেখে। তার ভালো লাগল গ্রামের সবুজ সবুজ ঘাসে হাত রাখতে। তারপর হঠাৎ সে বুঝতে পারে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। আমি বলে উঠলাম, ‘চুপ কর রুমী, চুপ কর।’ আমার চোখে পানি টলমল করে এল। হাত বাড়িয়ে রুমীর মাথাটা বুকে টেনে বললাম, ‘রুমী। এত কম বয়স তোর, পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না। জীবনের কিছুই তো জানলি না।’ রুমী মুখ তুলে কি একরকম যেন হাসি হাসল। মনে হল অনেক বেদনা সেই হাসিতে। একটু চুপ করে থেকে বলল, বিন্দু সিন্ধু-দর্শন একটা কথা আছে না আম্মা? হয়তো জীবনের পুরোটা তোমাদের মত জানি না, ভোগও করি নি, কিন্তু জীবনের যত রস-মাধুর্য-তিক্ততা-বিষ- সবকিছুর স্বাদ আমি এর মধ্যেই পেয়েছি আম্মা। যদি চলেও যাই, কোন আক্ষেপ নিয়ে যাব না। ২৯ আগস্ট। রাতে সাইড টেবিলে বেডিওটা খোলা রয়েছে। একের পর এক বাংলা গান হচ্ছে। খুব সম্ভব কলকাতা। হঠাৎ কানে এল খুদিরামের ফাঁসির সেই বিখ্যাত গানের কয়েকটা লাইন। “একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। ওমা হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী।” রুমী বলল, ‘কি আশ্চর্য আম্মা! আজকেই দুপুরে এই গানটা শুনেছি। রেডিওতেই, কোন স্টেশন থেকে- জানি। আবার এখনো রেডিওতে। একই দিনে দু’বার গানটা শুনলাম, না জানি কপালে কি আছে।’ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠৎ নিচে গেটে ধমাধম শব্দ আর লোকের গলা শুনে চমকে জেগে উঠলাম। বাড়ির সামনের পুবদিকের জানালার কাছে উঁকি দিয়ে দেখি- সর্বনাশ! সামনের রাস্তায় মিলিটারি পুলিশ। রাস্তার উজ্জ্বল বাতিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দৌড়ে রুমীদের ঘরের পশ্চিমের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখলাম পেছনে বজলুর রহমান, সাত্তার, কাসেম সাহেবদের বাড়িগুলোর সামনের রাস্তাতেও অনেক মিলিটারি পুলিশ। দক্ষিণের জানালা দিয়ে দেখলাম ডাঃ এ. কে. খান ও হেশাম সাহেবের বাড়ির সামনের জায়গাটাতেও পুলিশ। উত্তর দিকের জানালা দিয়ে দেখলাম আমার পুরো বাগান ভরে মিলিটারি পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে! অর্থাৎ বাড়িটা একবারে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে। আবার রুমীর ঘরে গেলাম। রুমী দু’একবার অস্থিরভাবে পায়চারি করে বলল, ‘কোনদিক দিয়েই পালাবার ফাঁক নেই। মনে হয় হাজারখানেক পুলিশ এসেছে। রাস্তার বাতিগুলোও এমন জোরালো, একেবারে দিনের মত করে রেখেছে।’ আমি উদভ্রান্তের মত ঘরের চারদিকে তাকিয়ে ভাববার চেষ্টা করলাম, কোনোখান দিয়ে কোনোভাবে রুমীকে পার করে দেয়া যায় কিনা! না কোনদিক দিয়েই কোন ফাঁক নেই। পুরো বাড়িটার যতো জানালা সবক’টাতে গ্রিল, পুরো বারান্দা কঠিন গ্রিলে আবদ্ধ। সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে পেছনের উঠানে নামবে, তারও উপায় নেই। পেছনের বাউন্ডারি ওয়াল খুব নিচু। পেছনের রাস্তার বাতি আর অসংখ্য পুলিশের চোখ এড়িয়ে উঠান দিয়েও পালানো সম্ভব নয়। ওদিকে সামনের গেটে অসহিষ্ণু হাতের ধমাধম বাড়ি আর ক্রুদ্ধ কণ্ঠের হাঁকডাক ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমি আর শরীফ পরস্পরের দিকে তাকালাম। এই মুহূর্তে আমার মনের ভেতরে কোন অনুভূতি আমি টের পাচ্ছি না। ভয়-ভীতি-উদ্বেগ সব ফ্রিজ হয়ে আমি যেন পুতুল নাচের পুতুল হয়ে গেছি। কেউ দড়ি দিয়ে যেন আমাকে ঘোরাচ্ছে, ফেরাচ্ছে, চালাচ্ছে। আমি আর শরীফ দু’জনে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলাম। দেয়ালে ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলাম বারোটা বেজে দশ মিনিট। একজন খুব অল্পবয়সী আর্মি আফিসার দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে ও পেছনে তাগড়া চেহারার অনেকেই। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘হোয়াট ক্যান উই ডু ফর ইউ?’ অফিসার হাত তুলে সালাম দেবার ভঙ্গি করে ইংরেজিতে বলল, ‘আমার নাম ক্যাপ্টেন কাইয়ুম। তোমাদের বাড়িটা একটু সার্চ করব। আমি বললাম, ‘কেন, কি জন্য?’ ‘এমন কিছু না। এই রুটিন সার্চ আর কি। তোমাদের বাড়িতে মানুষ কয়জন? কে কে থাকে? আমি বললাম, ‘আমি, আমার স্বামী, শ্বশুর, দুই ছেলে, ভাস্তে- ছেলেদের নাম কি? ‘রুমী, জামী-’ অভ্যস্ত নিপুণতার সঙ্গে ওরা প্রত্যেকটি ঘরের আলমারি, দেরাজ চেক করে দেখল, পেছনের দরজা খুলে উঠানে উঁকি মারল, বাবার ঘরে পা টিপে টিপে হাঁটল, রুমীদের সবাইকে নাম জিগ্যেস করে নিচে নেমে যেতে বলল। জিগ্যেস করলাম, ‘কেন, ওদের নিচে যেতে বলছ কেন? ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বলল, কিছু না, একটুখানি রুটিন ইন্টারোগেশান করব। শরীফের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনিও নিচে আসুন। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম পোর্চে এসে শরীফকে বলল, এটা আপনার গাড়ি? চালাতে পারেন? শরীফ ঘাড় নাড়লে সে বলল, আপনি গাড়ি চালিয়ে আমাদের সঙ্গে আসুন। আমি ভয় পেয়ে বলে উঠলাম, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’ ক্যাপ্টেন কাইয়ুম শান্ত মৃদুস্বরে বলল, এই তো একটু রমনা থানায়। রুটিন ইন্টারোগেশান। আধঘণ্টা পৌনে একঘণ্টার মধ্যেই ওরা ফিরে আসবে। শরীফ এতক্ষণ একটাও কথা বলে নি, এবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, তুমি থাক। বাবা একলা। শরীফ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বোধ হয় নীরবে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। আমি হঠাৎ যেন সম্বিত পেয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। তাকিয়ে দেখলাম কয়েকজন পুলিশ রুমী, জামী, মাসুমদের হাঁটিয়ে রওনা হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম শরীফের পশের সিটে উঠে বসল। আমি খানিকক্ষণ স্তম্ভিতের মত দাঁড়িয়ে রইলাম সেই শূন্য পোর্চে। তারপর বাড়ির ভেতর ঢুকে সব ঘরের সবগুলো বাতি একে একে জ্বালিয়ে দিতে লাগলাম। আধঘণ্টা গেল, একঘণ্টা গেল, দেড়ঘণ্টা গেল। ওরা ফিরে আসে না। আমি ঘর-বার করতে লাগলাম। ৩০ আগস্ট। ভোর হয়ে আসছে। ওরা ফেরেনি। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বলেছিল আধঘণ্টা পৌনে একঘণ্টা পরে ফিরবে। আমিও সে বিশ্বাসে ঘর-বার করে পাঁচ ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম? ওরা তো সোজাসুজি ধরে নিয়ে যেতে পারতো কিছু না বলে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম মিথ্যা বলল তাহলে? আটটার সময় থেকে আর্মি এক্সচেঞ্জে ফোন করতে লাগলাম ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে চেয়ে। কিন্তু কোন হদিস করতে পারলাম না। একবার বলে ‘উনি এখনো আসেন নি।’ আরেকবার শুনি ‘এই এক্সটেনসান ওনার নয়। অন্য এক্সটেনসান নম্বর দেয়- সেখানে চাই, তারা আবার অন্য একটা নম্বর দেয়। সাড়ে ন’টার সময় দরজায় কলিং বেল বাজল। দৌড়ে গিয়ে খুলে দেখি হাফিজ। একা। হাফিজকে টেনে ঘরের ভেতর এনে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, ‘হাফিজ! তুই এসেছিস বাবা। তুই একা কেন? তোর খালু কই? রুমী জামী, মাসুম? হাফিজের পরনে লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জারি দলামোচড়া, ধুলোময়লা মাখা। চোখে মুখে গভীর যন্ত্রণার ছাপ। ও একটু সুস্থির হয়ে বলল- ওদেরকে প্রথমে মেইন রোডে নিয়ে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে সামনে একটা জীপের হেডলাইট জ্বালিয়ে সবাইকে সনাক্ত করে। তারপর রুমীকে আলাদা করে নিয়ে ওদের জীপে ওঠায়। হাফিজ, মাসুম, জামীকে শরীফের গাড়িতে উঠতে বলে। শরীফকে বলে তাদের জীপটাকে ফলো করতে। ওরা জীপ ফলো করে এয়ারপোর্টের উল্টোদিকে এম.পি.এ হোস্টেলে যায়। সেখানে ওদের সবাইকে নিয়ে একটা ঘরে রাখে। সেখানে সারারাত ধরে ওদের সবার ওপর খুব মারধর করা হয়েছে। ৩১ আগস্ট। বেলা এগারোটার দিকে এম.পি.এ হোস্টেলে পৌঁছালাম। হোস্টেলের গেটে পুলিশ দাঁড়িয়ে রাইফেল হাতে। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে একে ওকে জিগ্যাস করতে করতে এঘর ওঘর করতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি একটু দূরে বারান্দা দিয়ে সফিন গুল যাচ্ছে। আমি এক নিশ্বাসে বললাম, সুবেদার সাহেব আমি ওদের খবর নিতে এসেছি। ওদের সঙ্গে দেখা করতে চাই। ওদের জন্য কিছু খাবার আর কাপড় এনেছি। একটু পর সুবেদার গুল আমাকে সম্বোধন করে বলল, মাইজী, ওনারা তো এখন এখানে নাই। ওনারা ক্যান্টনমেন্টে আছেন। এখন তো দেখা হবে না। আপনি বাড়ি চলে যান। এখানে অপেক্ষা করার সুবিধা নাই। আপনি পরে খবর নেবেন। নিজে আসবেন না। অন্য লোক দিয়ে খবর নেবেন। আমি বললাম, তাহলে এই প্যাকেট দুটো রাখেন। ওদের কাপড় আর কিছু খাবার। আমি ডাইনিং রুমে চৌকিটার ওপর শুয়ে পড়ে বললাম, ‘মা আপনি বাবাকে ‍সামলান। আমি এখন ওর সামনে দাঁড়াতে পারব না। কতক্ষণ এভাবে কেটেছিল কে জানে। হঠাৎ পোর্চে গাড়ির শব্দ। আমি লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুললাম। দেখি আমাদের সেই সাদা হিলম্যান মিংকস। গাড়ি থেকে নামছে শরীফ, জামী, মাসুম। শুধু রুমী নেই। আমার গলা চিরে একটা আর্তস্বর বেরোল, ‘রুমীকে ছাড়ে নি?’ কেউ কোন উত্তর দিল না। একে একে ঘরে এসে ঢুকল। আমি তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে তিনজনকেই জড়িয়ে ধরলাম। তারপর হঠাৎ চেতনায় ধাক্কা লাগল। ওদের পরনের লুঙ্গি, পাঞ্জাবী দলা-মোচড়া ছেঁড়া, ধুলো-ময়লা লাগা, ওদের মুখে-চোখে গভীর যন্ত্রণা, দুঃখ আর অপমানের ছাপ, ওদের শরীর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ওরা যেন দাঁড়াতে পারছে না। আমি বললাম, সুবেদার গুল বলল, তোমাদের নাকি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে। শরীফ বলল, না, আমাদের ক্যান্টমেন্টে নেয় নি তো! আমরা ঐ এম.পি.এ হোস্টেলেই ছিলাম। আমি তাজ্জব হয়ে বললাম, ‘কি রকম নিপাট মিথ্যা কথা বলে ওরা! আমি আবার তোমাদের জন্য এক প্যাকেট স্যান্ডউইচ, সবার জন্য একসেট করে কাপড় গুলের কাছে দিয়ে এলাম। ওগুলো আবার রাখলও সে। তখনি তো বলে দিতে পারতো, তোমাদের ছেড়ে দিয়েছে। তাহলে এক সঙ্গেই ফিরতে পারতাম। জামী বলল, মা, তুমি এখনো তোমার মান্ধাতা আমলের ধারণা নিয়ে বসে আছ। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে ব্রিটিশরা রাজবন্দিদের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করত- আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে দিত, খাবার, কাপড় পাঠাতে দিত, তারপর ফাঁসি দিয়ে লাশটা আত্মীয়দের ফিরিয়ে দিত। ভাবছ এখনো ব্যবস্থা ওইরকমই আছে? জেনে রাখ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর এই পাঁচ মাসে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এ বিষয়ে পাঁচশো বছর এগিয়ে গেছে। ওদের কীর্তিকলাপ শুনলে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীও মাথা হেঁট করবে।