Image description

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় একটি মসজিদে ইমাম ও খতিব ছিলেন মাওলানা রইস উদ্দিন। গত ২৭ এপ্রিল সকালে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে একটি ‘মব’ (উচ্ছৃঙ্খল জনতা) তৈরি করা হয়। তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এরপর তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হলে পুলিশ আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠায়। ওই রাতেই মারা যান তিনি। পরিবারের অভিযোগ, পূর্বশত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষ রইস উদ্দিনকে মব তৈরি করে হত্যা করেছে।

গাজীপুরের মসজিদের এই ইমামের মতো মব বা মব জাস্টিসের (উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে বিচার) ঘটনা ঘটছে প্রতি মাসেই। সর্বশেষ গত রোববার রাজধানীর উত্তরায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদাকে ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’ কর্তৃক আটকের পর জুতার মালা ও জুতাপেটা করার মতো লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনা নিয়ে সমালোচনাও চলছে।

যদিও সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই মবের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে আসছে বারবার। সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোও মবের বিরুদ্ধে। তবু থামছে না এই ‘ভয়ংকর অপরাধ।’

বরং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এই মব বা মব জাস্টিস বেড়েই চলছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ‘মব মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত, সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।’

মানবাধিকার সংস্থা ‘মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)’ প্রকাশিত গত পাঁচ মাসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশে ১৪১টি মবের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫২ জন নিহত এবং ২৮৯ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ১৩০ জনকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা মারধর করে পুলিশে দিয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও নিজস্ব গবেষণায় এ তথ্য পেয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাটি।

এমএসএফের তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে ২১টি মবের ঘটনায় ১২ জন নিহত ও ৩৮ জন আহত হন। তাদের মধ্যে ২০ জনকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় মবকারীরা। ফেব্রুয়ারি মাসে ১৮ মবের ঘটনায় ৮ জন নিহত ও ৩৪ জন আহত হন। তাদের মধ্যে ১৫ জনকে আহত অবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়। মার্চে মবের ঘটনা ঘটে ৩৯টি। এসব ঘটনায় ওই মাসে ১৩ জন নিহত ও ৯৬ জন আহত হন উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে। তাদের মধ্যে ৪০ জনকে পিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এপ্রিলে ২৭টি মবের ঘটনায় ১০ জন নিহত ও ৫৩ জন আহত হন। তাদের মধ্যে ২৫ জনকে পুলিশে সোপর্দ করে উচ্ছৃঙ্খল জনতা। মে মাসে ৩৬টি মবের ঘটনায় ৯ জন নিহত ও ৬৮ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে ৩০ জনকে পুলিশে দেওয়া হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব সময়ই ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ হামলা’ বা ‘মব ভায়োলেন্স’ ঠেকাতে তৎপরতার কথা জানিয়ে আসছে। এর পরও একের পর এক এ ধরনের সংঘবদ্ধ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম কিছুটা বিব্রত হন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘মব ভায়োলেন্সের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেনাবাহিনীসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর। এরপরও বিশেষভাবে আর কিছু বলার থাকতে পারে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, মব যারা সৃষ্টি করছে তারা খুবই সংগঠিতভাবে এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে সেগুলো করছে। পুলিশের কাছে এ বিষয়টি অজানা নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশ নিজেই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত, মব আটকাতে গিয়ে পুলিশ নিজেই মবের শিকার হতে পারে, এই একটি বিষয় তাদের মনে কাজ করে। এজন্য তারা বিষয়টি প্রতিরোধ করতে পারছে না।

মবের বিরুদ্ধে সরকারের হুঁশিয়ারি, তবুও থামছে না এই অপরাধ: গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। ওই সময়ের পর কয়েক মাস ধরে মব সৃষ্টি করে বিভিন্ন বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে হানা দেয় এক শ্রেণির উচ্ছৃঙ্খল লোক। লোকজনকে ধরে ধরে মারধর এমনকি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এই মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দেয় সরকার। সরকারের উপদেষ্টারাও এই অপরাধ বন্ধে নিজেদের কঠোরতার কথা জানায়।

সর্বশেষ গত রোববার সাবেক সিইসি মবের শিকার হয়ে লাঞ্ছিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি জানায়, মব সৃষ্টি করে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী সবাইকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

সাবেক সিইসিকে মবের মাধ্যমে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় গতকাল সোমবার গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তার সঙ্গে (সাবেক সিইসি নূরুল হুদার) যেটা হয়েছে, মানে গলায় এটা—সেটা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

এর আগে গত ২২ এপ্রিলে যশোরে এক অনুষ্ঠানে হুঁশিয়ারি দিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘মব জাস্টিস আর অ্যালাও (অনুমোদন) করা যাবে না। অনেক হয়েছে। কারও কোনো কিছু বলার থাকলে আইনের আশ্রয় নেবে।’

এর আগে গত ৯ মার্চ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এক বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জানান, ‘এখন থেকে যে কোনো ধরনের মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে। যিনিই ‘মব জাস্টিস’ করুন না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনতে আজ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

মবের বিরুদ্ধে অবস্থান রাজনৈতিক দলের: বিএনপির অবস্থান ‘মব’ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘আমরা মব কালচারে বিশ্বাস করি না, আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমরা চাই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং আদালতের রায় বাস্তবায়ন হবে, বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকবে।’

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদাকে হেনস্তা করার ঘটনায় দলের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ‘শৃঙ্খলাবিরোধী ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সাবেক প্রধান সিইসি নুরুল হুদার সঙ্গে মব ঘটনায় যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

অবশ্য গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান অভিযোগ করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতার কারণেই মবের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেছেন, সরকার যত দিন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে না, তত দিন সমাজ থেকে মবোক্রেসি বন্ধ হবে না। মব উৎপাদনের দায় পুরোপুরি সরকারের। গতকাল সকালে ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ কথা বলেন।

দুই মানবাধিকার সংগঠনের বিবৃতি: সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের প্রতি ‘অপমানজনক ও সহিংস আচরণের’ ঘটনায় বিবৃতি দিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি বেআইনি সমবেত হয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে মারধর করে এবং পরে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে প্রকাশিত এ দৃশ্য শুধু একজন ব্যক্তির প্রতি নয়, বরং দেশের সংবিধান, মানবাধিকারের ন্যূনতম মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের প্রতি সরাসরি আঘাতের নামান্তর।’

আসক জানায়, একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে যদি কোনো গুরুতর অভিযোগ থেকেও থাকে, তা নিষ্পত্তির একমাত্র পথ হচ্ছে সংবিধান ও প্রচলিত আইনের নির্ধারিত প্রক্রিয়া। বিচার ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে যে কোনো অপমানজনক ও সহিংস আচরণ শুধু ব্যক্তি অধিকারকেই লঙ্ঘন করে না, তা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ ধরনের ঘটনাগুলোয় সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

আরেক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এক বিবৃতিতে বলেছে, কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংঘটিত করলে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার করতে হবে। বিচার ব্যতিরেকে ‘মব’ বা জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত। এ ধরনের আচরণ দেশের আইনি কাঠামো, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ।