আজ ভোরে ৪.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা। মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানিয়েছে, ভূমিকম্পটি উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে মাত্র ৪২ কিলোমিটার দূরে দোহারের উত্তর-পশ্চিমে। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল রাজধানীর এত কাছে ও ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে হওয়ায় এ নিয়ে চিন্তার কথা জানিয়েছেন ভূ-তত্ত্ববিদরা। ঢাকা শহর ও এর আশেপাশের এলাকা বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে ভূ-তত্ত্ববিদরা আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছেন।
এদিকে সাত-সকালে রাজধানীতে ভূকম্পনের ঝাঁকুনিতে অনেকের ঘুম ভেঙে যায়। আতঙ্কিত হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের প্রতিক্রিয়া জানান তারা। ভূমিকম্পের পরপরই নাদিয়া ইসলাম তার ফেসবুকে লেখেন, ভূমিকম্প হয়েছে। সময় ভোর ৫:৫৭। মোটামুটি ১০-১৫ সেকেন্ড ধরে ছিল। আস্তে শুরু হয়ে একটা জোরে ঝাঁকুনি দিলো।
আল্লাহ রক্ষা কর আমাদের।
রুশা চৌধুরী নিজের স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘হঠাৎ মনে হল কে যেন আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে। চমকে উঠতেই দেখি সবকিছু নড়ছে। মা-মেয়ে দৌড়ে নিচে নামলাম।
আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ তার ফেসবুকে একটি পোস্টে বলেন, ঢাকার এত কাছে এত সক্রিয় ভূ-চ্যুতি রয়েছে সেটাও খুবই চিন্তার বিষয়। ঢাকায় বিল্ডিং এর ক্ষয়-ক্ষতির আশংকা করা যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেছেন, এর আগে যেসব ভূমিকম্প আমরা লক্ষ্য করেছি, সেগুলো ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩৫-৪০ কিলোমিটার গভীরে উৎপত্তি হয়েছে। এই ভূমিকম্পটি সেগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত অনেকটাই অগভীর। এই ভূমিকম্পের তথ্য নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে এটির সম্পর্কে আরো তথ্য জানানো যাবে বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞদের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে আট মাত্রা বা তার চেয়ে বড় ধরণের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেরকম ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের অন্তত ছয় হাজার ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রাণহানি হবে অন্তত তিন লাখ মানুষের - এমন আশংকা বিশেষজ্ঞদের।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া ৬০ শতাংশ ভবন মূল নকশা পরিবর্তন করে গড়ে ওঠায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের সময় এ অপরিকল্পিত ভবনগুলো সঙ্গে সঙ্গেই ধসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভূমিকম্প অসহনশীল ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংস্কার বা ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই।
ঢাকার কাছে যেসব ভূমিকম্প
ভূ-তত্ত্ববিদরা বলছেন বাংলাদেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি প্লেট থাকার কারণে এসব এলাকা ভূমিকম্পের বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ঢাকায় গত কয়েক বছরের মধ্যে যেসব ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশের উৎপত্তিস্থলই ছিল বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে সিলেট বা চট্টগ্রাম অঞ্চলে। অনেকগুলো ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল ভারতের মিজোরাম বা ত্রিপুরা রাজ্যে। তবে শুক্রবারের ভূমিকম্পের মত ঢাকার আশেপাশে উৎপত্তিস্থল রয়েছে, এমন ভূমিকম্পও মাঝেমধ্যেই হতে দেখা গেছে।
ভূ-তত্ত্ববিদ হুমায়ুন আখতারও বলেন, "২০০৮ থেকে ২০১২-১৩ পর্যন্ত ঢাকার কাছাকাছি নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা অঞ্চলে গ্রীষ্মের সময় অনেকগুলো ছোট ছোট ভূমিকম্প হতে দেখেছি আমরা।"
ভূমিকম্প শনাক্তকারী সংস্থা আর্থকোয়েকট্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালের ১৮ই মার্চ এই অবস্থানেই- দোহার থেকে ১৪.২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ৪.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল।
ঢাকার কাছে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলেও গত বিশ বছরের মধ্যে একাধিক ছোট ছোট ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে।
তিন বছর আগে, ২০২০ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ১২ কিলোমিটার পূর্বে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।
এছাড়া ২০০৮ এ টাঙ্গাইলের কাছে নাগরপুরে এবং ২০১৯ সালে মির্জাপুরে চার মাত্রার নিচে ভূমিকম্প হয়েছে বলে বলছে আর্থকোয়েকট্র্যাক। গত ১৫ বছরে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জে অন্তত চারবার ভূমিকম্প হয়েছে বলে জানাচ্ছে সংস্থাটি।
আর ঢাকার কাছে ফরিদপুরেও গত ১৫ বছরের মধ্যে দুইবার চার মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছে বলে নথিবদ্ধ করেছে সংস্থাটি।
তবে গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে ঢাকার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে নথিবদ্ধ করা হচ্ছে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জে ৫.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্পকে।
বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন