বিটিভিতে অগ্নিকাণ্ডঃ শেখ হাসিনার পদক্ষেপ ছিল সন্দেহজনক
কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশে গত ১৮ জুলাই দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি-তে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কি পয়েন্ট ইন্সটেলশন-কেপিআই) বিটিভি-তে হামলা ও আগুন নিয়ন্ত্রণে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা ছিল একেবারেই সন্দেহজনক।
ঘটনাপ্রবাহ:
১৮ জুলাই বেলা আনুমানিক একটার দিকে বিটিভির ১ নম্বর গেটে প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় হামলাকারীরা পুলিশকে ধাওয়া দিতে দিতে বিটিভির গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এই হামলায় সীমিত পরিসরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। খুব একটা ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি।
প্রথম দফা হামলার পরপরই প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম বিটিভিতে হামলার ঘটনা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন।
বেলা আনুমানিক আড়াইটা থেকে তিন টার দিকে বিটিভিতে দ্বিতীয় দফা হামলার ঘটনা ঘটে। এ দফায় বিটিভির অভ্যর্থনা, নিরাপত্তা কক্ষ, বিটিভির সদরদপ্তরের নিচ তলায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বিটিভির অভ্যর্থনা কক্ষ, গাড়ির গ্যারেজ এবং সেট ডিজাইন সরঞ্জাম রাখার গোডাউনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এ দফায়ও প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার বিটিভিতে আগুন লাগার ঘটনা এবং ভাঙচুরের ঘটনা শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন।
স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলামকে বলতে শোনা গেছে, বিটিভির সেট ডিজাইনে আগুন লেগেছে। পুরো বিটিভি পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। এখনই জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
নজরুল ইসলামের আবেগাপ্লুত কথার বিপরীতে উদ্বেগহীন ও নির্লিপ্ত শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, পুড়ে যাক। আমি আবার নতুন করে বিটিভির সব করে দেব।
শেখ হাসিনার এই কথাটা নজরুল ইসলাম ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মো. নজরুল ইসলামের রুমে থাকা আরও দুই জন সরাসরি নিজের কানে শুনেছেন। তারা হলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের সংযুক্ত রিপোর্টার মাজহারুল আনোয়ার খান শিপু (বাসস) এবং মহিউদ্দিন মাহমুদ (বাংলানিউজ)।
শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে ফোন রাখার পর হতাশ স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলছেন সব পুড়ে যাক, নতুন করে সব করে দেবেন।
এ সময় নজরুল ইসলামের রুমে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ে সংযুক্ত বিটিভির কর্মকর্তা আসিফুর রহমান এবং ফাহাদ ফেরদৌস (ইউএনবি)।
এরপর মো. নজরুল ইসলাম নিজেই পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন। দ্রুত বিটিভির আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু কারো কাছে আশানুরূপ সাড়া পাননি।
এক পর্যায়ে নজরুল ইসলাম উত্তেজিত হলে বলেন, শুয়েরের বাচ্চাদের চাকুরি খাব। এরা কথা শুনছে না।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন মিডিয়ার প্রতিনিধিদের বলা হয়, বিটিভির আগুনের ঘটনা যাতে বেশি করে প্রচার করা হয়। মিডিয়াগুলোকে বার বার তাগিদ দেওয়া হয় যাতে এ ঘটনা বেশি বেশি করে প্রচার করা হয়। ৭১টিভি, সময় টিভিসহ বেশ কিছু চ্যানেল ফলাও করে তা সম্প্রচারও করে।
সন্ধ্যার দিকে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করলে নজরুল ইসলাম আবার শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার পর নজরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী হার্ড লাইনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ওপেন ফায়ার করতে বলেছেন।
এদিকে সন্ধ্যার পর বিটিভিতে আবার হামলা হয়। এই হামলায় বিটিভির ট্রান্সমিশন বিভাগ এবং নিউজরুম ছাড়া সব কিছু ভেঙে তছনছ করা হয়।
এদিকে বিকেলে যখন সেট ডিজাইন বিভাগে আগুন লাগে, তখন বিটিভির কয়েকজন কর্মকর্তা বিটিভির জিএম মাহফুজাকে সেট ডিজাইন গোডাউনের পাশে হিসাবরক্ষণ ও প্রশাসন বিভাগ থেকে কাগজপত্রগুলো সরিয়ে আনার পরামর্শ দেন। কিন্তু মাহফুজা কৌশলে কাগজপত্রগুলো সরাতে দেননি।
গণভবন সূত্র জানায়, বিটিভির আগুনের ঘটনা শোনার পর শেখ হাসিনাকে বিচলিত বা মন খারাপ করতে দেখা যায়নি। তিনি একেবারে উদ্বেগহীন ও স্বাভাবিক ছিলেন।
একজন কর্মকর্তা বলেন, পরবর্তীতে যখন দেখলাম প্রধানমন্ত্রী বিটিভিতে গিয়ে কাঁদছেন, তখন আমরা খুব অবাক হয়েছি। কারণ যখন আগুন লাগে বা হামলার ঘটনা ঘটে, তখন তিনি একটা সময় পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় ছিলেন। হয়তো অপেক্ষা করেছেন, বেশি করে যেন ধ্বংস হয়। এটিকে দেখিয়ে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে মাঠ ছাড়া করবেন।
এদিকে বিটিভির একজন কর্মকর্তা বলেন, সন্ধ্যার পর যে হামলা হয়েছে সেই হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিটিভির।
তিনি বলেন, বিটিভির হামলার ঘটনায় ঠিকাদার কামরুলকে ধরা হয়েছে। ফুটেজে তাকে হামলার নির্দেশনা দিতে দেখা গেছে। কেউ একজন ভিডিও করে সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়। পরে সেটা নিউজ২৪ টিভিতে প্রচারও হয়।
এই কর্মকর্তা সন্দেহ পোষণ করে বলেন, ঠিকাদার কামরুল দীর্ঘদিন বিটিভির ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে। সে বিটিভির প্রতিটি অলিগলি সব চেনে। অবাক করা ব্যাপার হলো, সে সব কিছু ভাঙার নেতৃত্ব দিয়েছে কিন্তু ট্রান্সমিশন বিভাগ ও নিউজরুমে কোন হামলা করেনি। এখানে সবাইকে জিম্মি করে ঘোষণাও দিয়ে দিতে পারতো, সেটাও করেনি। এখানে কোন যোগসাজশ থাকতে পারে।
বিটিভির আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিলে বিটিভিতে এত ধ্বংসযজ্ঞ হতো না। রাতের বেলা বিটিভিতে সবচেয়ে বেশি ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, পুরো বিটিভি ভেঙে তছনছ করা হয়েছে। কিন্তু ট্রান্সমিশন বিভাগ ও নিউজরুমে কোন হামলা হয়নি। যেসব জায়গায় ভাঙচুর হয়েছে তার আশপাশেই এগুলো ছিল।
তিনি বলেন, এর পেছনে কোন ষড়যন্ত্র আছে কি না, এটা তদন্ত করে দেখা উচিত।