
কুমিল্লার মুরাদনগরে ধর্ষণের শিকার সেই নারী এতদিন না চাইলেও এখন মামলা চালাতে চান। সোমবার রাতে পারিবারিক সিদ্ধান্তে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে সাংবাদিক, ইউটিউবার ও রাজনীতিকদের ‘চাপে’ মঙ্গলবার বাড়ি ছেড়েছেন তিনি।
এদিকে অপকর্মে জড়িতরাও এলাকাছাড়া। সেই নারী মামলা চালিয়ে যাবেন-এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আতঙ্ক আরও বেড়েছে। নতুন করে আর কাউকে গ্রেফতারও করতে পারেনি পুলিশ। বর্তমানে চারজন জেলহাজতে রয়েছেন, মঙ্গলবার তাদের রিমান্ড শুনানি হয়নি। কাল এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রুহুল আমিন। এছাড়া গ্রেফতার একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সূত্র জানায়, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাহেরচর গ্রামে বৃহস্পতিবার রাতে ওই নারী নির্যাতনের শিকার হন। শুক্রবার ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করা হয়। তাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে পৃথক মামলা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ধর্ষক ফজর আলী এবং নির্যাতন ও ভিডিওধারণের হোতা রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মুহাম্মদ আলী সুমন ও তার তিন সহযোগীকে গ্রেফতার করে।
তবে অজ্ঞাত কারণে ওই নারী মামলা চালিয়ে যেতে চাইছিলেন না। তিনি ‘শান্তি চান’ বলে জানিয়ে আসছিলেন।
ভিকটিম নারী বলেন, শুরুতে আমার স্বামী বলেছিল মামলা না করতে। এজন্য মামলা নিয়ে আমার অনীহা ছিল। সোমবার রাতে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা এ বিষয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে যাব। তাই আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্যাতন এবং ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে আমি আইনি লড়াই করব। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন। আমার নিরাপত্তাসংক্রান্ত কোনো সমস্যা নেই।
মঙ্গলবার সকাল থেকে ওই পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ বলছে, ঘটনার পর প্রতিদিনই তাদের বাড়িতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন ভিড় করছেন। এছাড়া গণমাধ্যমকর্মী ও ইউটিউবারদের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে দিতে তার জীবন ‘দুর্বিষহ’ হয়ে উঠেছে। এমন ‘বিব্রতকর’ পরিস্থিতি এড়াতে তারা বাড়ি ছেড়ে গেছেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল করিম বলেন, সোমবার বিকালে ওই নারী তার স্বামীর বাড়ি যাবেন বলে বাবার বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। পুলিশের সহযোগিতায় তিনি দুই সন্তানকে নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছেন। এরপর তার মা-বাবাসহ পরিবারের লোকজনও অন্যত্র চলে যান। এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার তাদের বাড়ি আসেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ। তার আগমন উপলক্ষ্যে হাজারো মানুষ মঙ্গলবার বেলা ১১টার পর থেকে তার বাবার বাড়ি ও আশপাশে অবস্থান নেন। এভাবে লোকজনের ভিড় হবে-সম্ভবত বিষয়টি বুঝতে পেরে ভুক্তভোগী ও তার বাবার বাড়ির লোকজন বাড়ি থেকে সরে গেছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রুহুল আমিন বলেন, ঘটনার পর থেকেই ভুক্তভোগী নারী ও তার পরিবারের সদস্যরা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। প্রতিদিনই তাদের বাড়িতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন ভিড় করছেন। গণমাধ্যমকর্মী ও ইউটিউবারদের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে দিতে ভুক্তভোগীর পারিবারিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এছাড়া অনেকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভিডিওতে ভুক্তভোগীর চেহারা দেখিয়ে আরও সমস্যায় ফেলছেন। এসব কারণেই ভুক্তভোগী বাড়ি থেকে সরে গেছেন। রুহুল আমিন আরও বলেন, ভিকটিম পরিবারকে আমরা সাপোর্ট দিচ্ছি। তারা মামলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি।
মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুর রহমান বলেন, ‘শুনেছি নির্যাতিত ওই নারী তার শ্বশুরবাড়ি বা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে গেছেন। এটি তার নিজস্ব ও ব্যক্তিগত ব্যাপার।’ ভুক্তভোগীর কোনো নিরাপত্তার দরকার হলে আমরা তা নিশ্চিত করব।
জড়িত আরও কয়েকজনকে খুঁজছে পুলিশ : ওই নারীকে নিপীড়নের দৃশ্যধারণের সঙ্গে জড়িত আরও কয়েকজনকে খুঁজছে পুলিশ। তবে এর আগে থেকেই সন্দিগ্ধ আসামিরা গা ঢাকা দিয়েছেন। তাছাড়া পুলিশ আতঙ্কে আশপাশের লোকজনও আত্মগোপনে রয়েছেন।
পুলিশ জানায়, নিপীড়নের পর ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেফতার ব্যক্তিদের মোবাইল ফোন পাঠানো হচ্ছে ফরেনসিক পরীক্ষায়। তবে প্রথমে কার আইডি থেকে এটি ছড়ানো হয়েছে, সেটি চিহ্নিত করা যায়নি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলছেন, ঘটনার রাতে ভুক্তভোগীর ঘরে ঢোকার পরই নিপীড়নে জড়িতরা তাদের মোবাইল ফোনের ক্যামেরা সচল করে। ওই নারী ও ফজর আলীকে মারধর করে তার ভিডিওধারণ করে তারা। এ ঘটনায় ফজরের ভাই শাহ পরান ছাড়াও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা সুমন জড়িত ছিল। এছাড়া রমজান, অনিক, আরিফসহ ১৫-২০ জনের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে। বিবস্ত্র করে নির্যাতনের সময় ওই নারী বাঁচার জন্য আহাজারি করতে থাকেন। একপর্যায়ে ভুক্তভোগী চিৎকার করলে তার মুখ চেপে ধরা হয়।
মুরাদনগর থানার ওসি জাহিদুর রহমান বলেন, আমরা এজাহার অনুসারে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করতে পেরেছি। ঘটনায় জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মুরাদনগর সার্কেল) একেএম কামরুজ্জামান বলেন, ওই নারীকে ট্রমা কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আনতে সবার সহযোগিতা জরুরি। নির্যাতন ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।
ভিকটিমের বাড়িতে কায়কোবাদ : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ মঙ্গলবার দুপুরে ওই নারীর বাড়িতে যান। এ সময় তিনি বলেন, বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আপনাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সংখ্যালঘু ভাইদের সবাই মিলেমিশে নিরাপত্তা দিতে হবে। এ পৈশাচিক নির্যাতনের ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক, তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। এ এলাকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করব। তিনি বলেন, মুরাদনগরে ধর্ষণকাণ্ডের ঘটনাটি বিএনপির ওপর দায় চাপাতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত তথ্য এখন বেরিয়ে এসেছে।