হাইকোর্টে বিএনপি সমর্থক আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিমকী ইমাম খানের ওপর আওয়ামী লীগের হামলা : শফিউদ্দিন বিটু
‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’ বা গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ঠেকিয়ে দিয়েছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকদের হামলা ও বাধায় গতকাল রাস্তায় দাঁড়াতে পারেনি মানুষ। খালেদা জিয়ার আহ্বানে ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’ ঠেকাতে গিয়ে সরকারি নির্দেশে পুরো দেশ স্থবির হয়ে পড়ে। রাজধানীর প্রবেশ পথগুলো অবরুদ্ধ করে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার সমর্থকরা। দেশের কোনো এলাকা থেকেই রাজধানীতে যানবাহন আসতে দেয়া হয়নি। খালেদা জিয়াকে তার গুলশানের বাসা থেকে রাস্তায় বের হতে দেয়নি পুলিশ। পুলিশের সহায়তায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং জাতীয় প্রেস কাবে তাণ্ডব চালিয়েছে আওয়ামী লীগের লোকেরা। সুপ্রিম কোর্টের মূল ফটকে পুলিশের সাথে ১৮ দলীয় জোট সমর্থক আইনজীবীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় পুলিশের গুলিতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের এক নেতা নিহত হয়েছেন। কমলাপুরে দুর্বৃত্তদের বোমায় রেলওয়ে পুলিশের হাবিলদার আবুল কাশেম নিহত হয়েছেন। সন্ধ্যার পর জাতীয় প্রেস কাবের সামনে গ্রেফতার হয়েছেন বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী মেজর হাফিজ।
খালেদা জিয়ার ঘোষিত কর্মসূচি ঠেকাতে গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর প্রবেশ পথসহ বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্রশস্ত্রসহ মহড়া দিতে দেখা যায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিকলীগের নেতাকর্মীদের। পুলিশের সামনে তাদেরকে প্রকাশ্যে মহড়া দিতে দেখা যায়।
খালেদা জিয়ার আহ্বানে মার্চ ফর ডেমেক্র্যাসি যাতে সফল না হয় সে জন্য কয়েক দিন ধরেই ব্যাপক তৎপরতা চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সরকার সমর্থকরা। গতকাল সকাল থেকে তারা পুরো রাজধানী অবরুদ্ধ করে ফেলে। মানুষ যাতে রাস্তায় বের হতে না পারে সে জন্য যত পদ্ধতি রয়েছে তার সবই প্রয়োগ করে তারা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো হয় পুলিশি চেকপোস্ট। পুলিশের হাতে হয়রানির শিকার হন সাধারণ পথচারীরাও।
পুলিশের সহায়তায় সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের ওপর হামলা চালিয়েছে যুবলীগ ও ছত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। গতকাল মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি উপলক্ষে আইনজীবীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেটে অবস্থান নিলে বেলা ৩টা ২০ মিনিটে শাসকদলীয় ক্যাডাররা তাদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় তাদের হাতে লাঠি, লগি, বৈঠা, কাচের বোতল ও ইটপাটকেল ছিল। পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের হামলায় মারাত্মক আহত হয়েছেন ১০-১২ জন আইনজীবী। হামলার সময় একজন মহিলা আইনজীবীকে প্রহার ও বিবস্ত্র করা হয়। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে এবং বাড়ি ফেরার পথে ১৩ জন আইনজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেনি।
বেলা ১১টার দিকে পাঁচ শতাধিক আইনজীবী বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে মিছিল করে নয়া পল্টনের উদ্দেশে রওনা হন। তারা সুপ্রিম কোর্টের মেইন গেটে পৌঁছলে পুলিশ গেটটি তালাবদ্ধ করে দেয়। পরে তারা সেখানেই অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। পুলিশ তাদের অবস্থানের ওপর জলকামান থেকে পানি নিক্ষেপ করলে প্রাথমিকভাবে আইনজীবীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। পরে অবশ্য তারা আবার সংগঠিত হয়ে সুপ্রিম কোর্টের গেটে অবস্থান নেন এবং সরকারবিরোধী সেøাগান দিতে থাকেন। দুপুরের দিকে জলকামান ব্যবহারের পাশাপাশি দু’টি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পুলিশ। এতে আবু জাফর মানিক ও নজরুল ইসলাম পাপ্পু নামে দুইজন আইনজীবী মারাত্মক আহত হন।
সকালে আন্দোলনের সময় পুলিশের কড়া প্রহরায় সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের মিছিল সুপ্রিম কোর্টের পাশ দিয়ে যায়। তারা এ সময় বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য ও স্লোগান দেয়।
বেলা ৩টা ২০ মিনিটের দিকে সশস্ত্র যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা হঠাৎ সুপ্রিম কোর্টের গেটে অবস্থান নেয়। প্রধান গেট বন্ধ থাকলেও এ সময় পুলিশ তালা খুলে দিয়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডারদের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। গেট খুলে দেয়ার সাথে সাথে বহিরাগত ক্যাডাররা আইনজীবীদের লক্ষ্য করে ইট, পাটকেল ও কাচের বোতল নিক্ষেপ এবং তাদের ধাওয়া করতে থাকে। প্রায় পাঁচশত সশস্ত্র ক্যাডার একসাথে এ হামলা চালায়। এতে ভীত আইনজীবী ও সাংবাদিকেরা দিগি¦দিক ছুটতে থাকেন। আইনজীবীরা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে আশ্রয় নেন। বার ভবনের চার দিকে কলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে কোনো রকমে আত্মরক্ষা করেন তারা। ক্যাডাররা বার ভবনের চারদিক ঘিরে ফেলে। তারা এ সময় তাদের সাথে লড়াইয়ের জন্য আইনজীবীদের নিচে নামার আহ্বান জানায়। ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ঘণ্টাখানেক সময় ধরে সেখানে তাণ্ডব চালালেও পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্য তখন এগিয়ে আসেননি।
ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ধাওয়ার মুখে দৌড়াতে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দু’জন মহিলা আইনজীবী। তাদের দু’জনকেই বেদম প্রহার করে ক্যাডাররা। তাদের একজনকে বিবস্ত্র করে ফেলা হয়। ক্যাডারদের হামলায় মারাত্মক আহত হন রেহানা পারভীনসহ ১০-১২ জন আইনজীবী। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বার ভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করার পাশাপাশি যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা আইনজীবীদের তিনটি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেয়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সরকার সমর্থক ক্যাডাররা বার ভবন এলাকায় ভাঙচুর চালায় এবং বার ভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। তারা বার ভবন এলাকায় আইনজীবীদের খোঁজাখুঁজি করে এবং কয়েকজনকে মারধর করে। বার ভবনের ছাদ থেকে কয়েকজন আইনজীবীও এর জবাবে তাদের ওপর বোতল ও ইটের টুকরা নিক্ষেপ করে।
বেলা সোয়া ৪টার দিকে রমনা জোনের ডিসি মারুফ হোসেনের নেতৃত্বে কয়েক শ পুলিশ ও র্যাব বার ভবন এলাকায় অবস্থান নেয়। তারা সেখান থেকে বহিরাগত ক্যাডারদের সরিয়ে দেয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত বার ভবন ঘেরাও করে রাখে পুলিশ। মাগরিব আজানের সময় পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে।
সারা দিনের আন্দোলন কর্মসূচি পালনকালে ১৩ জন আইনজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সহসম্পাদক এ বি এম রফিকুল হক তালুকদার রাজা। এর মধ্যে সকালে প্রেস কাবে প্রবেশের সময় আটক করা হয় অ্যাডভোকেট ড. আরিফা জেসমিন নাহিনকে। বাকিদের কর্মসূচি শেষে বাড়ি ফেরার সময় বিভিন্ন প্রবেশ পথ থেকে গ্রেফতার করা হয়।
আইনজীবী নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন পরে সাংবাদিকদের বলেন, সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। এটি নজিরবিহীন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ঢুকে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা আইনজীবীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এটা চলতে পারে না। একই সাথে এর সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
সন্ধ্যায় এক ব্রিফিংয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এ বি এম রফিকুল হক তালুকদার রাজা বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। আমি প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছিÑ এর সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করতে অবশ্যই তিনি পদক্ষেপ নেবেন। বেলা ১১টায় বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ শতাধিক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট বার ভবন এলাকা থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে আরো অংশ নেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, বারের সভাপতি এ জে মোহাম্মদ আলী, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা, বারের সহসভাপতি এ বি এম ওয়ালিউর রহমান খান, অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, আশরাফুজ্জামান, জামিল আখতার এলাহি, গাজী কামরুল ইসলাম সজল, মোহাম্মদ আলী, আবদুল্লাহ আল মাহবুব, মিজানুর রহমান মাসুম, শরীফ উদ্দিন আহমেদ, মির্জা আল মাহমুদ, জে আর খান রবিন, কাজী জয়নাল, আইয়ুব আলী আশরাফী, সিদ্দিক উল্লাহ মিয়া, জহিরুল ইসলাম সুমন প্রমুখ।
প্রেস কাবে হামলা : জাতীয় প্রেস কাবে গতকাল চার দফা সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা। তাদের হামলা ও গুলিতে ৪০ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। এ ছাড়া প্রেস কাবের সামনে থেকে অন্তত ৩০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। সাংবাদিকদের ওপর এ হামলাকে ন্যক্কারজনক ও নজিরবিহীন উল্লেখ করে হামলার সাথে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। একই সাথে জাতীয় প্রেস কাবের সাংবাদিকদের চোর বলে উক্তিকারী পুলিশ অফিসার শিবলি নোমানের অপসারণ দাবি করেছেন তারা।
ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল রোববার জাতীয় প্রেস কাবের টেনিস কোট চত্বরে বন্ধ মিডিয়া খুলে দেয়ার দাবিতে সাংবাদিক সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। বেলা ১০টায় এ সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সাংবাদিক ও অতিথিরা কর্মসূচিতে আসার পথে প্রেস কাবের সামনে বাধার সৃষ্টি করে পুলিশ। এ সময় অনেককে আটক করা হয়। ফলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পুলিশের সাথে সাংবাদিকদের ধস্তাধস্তিও ঘটে। এর মধ্যেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবেশ শুরু হয়। এরপর সাংবাদিক নেতারা বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। তবে মাত্র তিনজন বক্তব্য দেন। এর মধ্যেই মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী ও ছাত্রলীগ সভাপতি বদিউজ্জামান সোহগের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা প্রেস কাবের সামনের রাস্তায় জড়ো হতে থাকে। টপ টেরর হান্নান ও নান্নুর উপস্থিতিতে লাঠি হাতে তারা তোপখানা রোডে দফায় দফায় মিছিল করে। দুপুর ১২টার দিকে হঠাৎ করেই সাংবাদিক সমাবেশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি চলায় প্রেস কাবের সামনে আগে থেকেই বিপুল ইট ও পিচের টুকরা জমা ছিল। ফলে আত্মরক্ষায় সাংবাদিকেরা সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। প্রেস কাবের গেট তালাবদ্ধ থাকায় কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যান তারা। আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা প্রেস কাবের সামনের ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলিও চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। হামলার সময় পুলিশ মূলত নীরব ভূমিকা পালন করলেও কোনো কোনো পুলিশ সদস্যকে ক্যাডারদের সহায়তা করতেও দেখা যায়। বেলা ১টার দিকে সাংবাদিকেরা আবারো সমাবেশস্থলে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা আগের মতোই ইট ও পিচের টুকরা নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলে আবারো সরে যেতে বাধ্য হন সাংবাদিকেরা। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগপন্থী সাংবাদিকেরা প্রেস কাব চত্বরে মিছিল বের করে। এ সময় আরেক দফা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের হামলায় ৪০ জন সাংবাদিক কমবেশি আহত হন। বিকেলের দিকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আরো একদফা হামলা চালায়। এর মধ্যেই প্রেস কাবের সামনে থেকে আটক অভিযান চালায় পুলিশ।
অবরুদ্ধ দেশ বিচ্ছিন্ন ঢাকা : আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারি দলের সদস্যরা গতকাল পুরো দেশ অবরুদ্ধ করে ফেলে। বিচ্ছিন্ন করে ফেলে রাজধানী ঢাকাকে। গতকালও ঢাকার বাইরে থেকে যানবাহন রাজধানীতে আসেনি। এমনকি ট্রেনও চলাচল করেনি। নৌযান ছিল বন্ধ। রাজধানীর আশপাশের কোনো যানবাহনও রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারেনি। রাজধানীর অভ্যন্তরীণ রুটগুলোর বাসও বন্ধ ছিল। বুড়িগঙ্গায় খেয়া নৌকা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। কোনো কোনো এলাকায় হেঁটেও যাতায়াত বন্ধ করে দেয় পুলিশ। দিনভর অবরুদ্ধ করে রাখা হয় রাজধানীর নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
নয়াপল্টন অবরুদ্ধ, আটক ৬ : মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচির কেন্দ্রস্থল নয়াপল্টন, ফকিরাপুল ও কাকরাইল এলাকা অবরুদ্ধ করে রাখে পুলিশ। নাইটিংগেল মোড় থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত সড়ক আগের রাতেই ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। দুই পাশেই পোশাকধারী ও সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান নেয়। গতকাল ভোর থেকে ওই সড়কে সাধারণের চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়। সাংবাদিকদের পরিচয়পত্র দেখে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। বিএনপি অফিসের সামনে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মিডিয়া কর্মী ছাড়া সারা দিন আর কাউকে দেখা যায়নি। বিএনপি বা বিরোধী দলের কেউ নয়াপল্টন বিএনপি অফিসের কাছেও ঘেঁষতে পারেনি। ওই এলাকায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট সব বন্ধ ছিল। পুরো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করে। মাঝে মধ্যে পুলিশ, র্যাবের টহল গাড়ি, পুলিশ কর্মকর্তাদের গাড়িবহর ব্যারিকেডের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখা যায়।
সকাল থেকে নাইটিংগেল মোড়ে সন্দেহভাজনদের আটক করতে শুরু করে পুলিশ। দুইজনসহ পুলিশ দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত নাইটিংগেল মোড় থেকে মহিলা দলের ৯ জনকে আটক করে। এর মধ্যে সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে নাইটিংগেল মোড়ে পিঠে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে ঘোরাঘুরির সময় একজনকে আটক করা হয়। পুলিশ তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করেন। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি হলে ভেতরে যাবেন এমন কথা জানাতেই তাকে টেনে হিঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে উঠানো হয়। এ সময় বিরোধী দলের কর্মসূচিতে যোগদানকারী সন্দেহে পুলিশ জুতার দোকানি জমসের আলী, মইনুল ইসলাম ও ফখরুল ইসলাম নামে আরো তিনজনকে আটক করে। গ্রেফতার করা হয় আরো দুইজনকে। বেলা সোয়া ১১টায় বাদল কুণ্ড নামে একজনকে আটক করা হয়। তিনি সাংবাদিকদের জানান, তিনি বিআরটিসি গাড়ির চালক। বেলা ১১টা ৩২ মিনিটে এলিজা জামান ও শিরীন আক্তার রীনা নামে মহিলা দলের দুই কর্মী নয়াপল্টন বিএনপি কার্যালয়ে যেতে চাইলে পুলিশ প্রথমে আটকে দেয়। পুরে মহিলা পুলিশ এসে টেনেহিঁচড়ে তাদের গাড়িতে ওঠায়। এ সময় এলিজা জামান চিৎকার করে বারবার বলতে থাকেন, ‘খালেদা জিয়াকে ছেড়ে দেখুন কী হয়’।
আটকের ৬ ঘণ্টা পর মুক্ত এনাম আহমেদ চৌধুরী : বেলা ১টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এনাম আহমেদ চৌধুরীকে পল্টন এলাকা থেকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশের অভিযোগ- তিনি ওই এলাকা দিয়ে নয়াপল্টনের দিকে যাচ্ছিলেন। আটকের পর তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
টঙ্গী থেকে ঘুরিয়ে দেয়া হয় পায়ে হাঁটা লোকদেরও : ময়সনসিংহের ত্রিশাল থেকে অটোবাইকে করে অসুস্থ মাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনছিলেন দিনমজুর সোহেল। পথের শত বাধা অতিক্রম করে টঙ্গী পৌঁছেছেন বেলা একটা ২০ মিনিট নাগাদ। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। টেলিফোন শিল্প সংস্থার মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও যুবলীগ-ছাত্রলীগ কর্মীদের সমন্বয়ে গড়া প্রতিরোধ কমিটির লোকেরা বাধা দেন তাদের। ইজিবাইকে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন মা জাহিদা। আর রাস্তায় নেমে পুলিশ-র্যাব ও সরকারদলীয় লোকদের হাত-পা ধরছিলেন ছেলে সোহেল। একে একে সবার কাছে গিয়ে কাকুতি-মিনতি করলেন তিনি। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। কারোরই মন গলাতে পারলেন না তিনি। এক ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করে ফিরে গেলেন অসুস্থ মাকে নিয়ে।
সোহেলের মতো ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর প্রভৃতি এলাকা থেকে শত শত মানুষ গতকাল অতি জরুরি কাজে টঙ্গী দিয়ে রাজধানী ঢাকায় আসছিলেন। কিন্তু র্যাব-পুলিশ ও সরকারি দলের কর্মীদের বাধায় তাদের অনেককেই টঙ্গী থেকে ফেরত যেতে হয়েছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং পায়েচালিত রিকশায় চড়ে কাউকেই ঢাকায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। হেঁটে যারা রাজধানীতে প্রবেশ করেছেন তাদেরকেও ডজন ডজন তল্লাশির শিকার হতে হয়েছে টঙ্গী, আবদুল্লাপুর, উত্তরা, বেড়িবাঁধ প্রভৃতি এলাকায়। পরিচয়পত্র ছাড়া কোনো পথচারীই এ পথে গতকাল ঢাকায় ঢুকতে পারেননি। তবে আটকে পড়া অনেককে ট্রাক-পিকআপে চড়ে বাড়ি ফিরে যেতে দেখা যায়।
গতকাল ভোর ৫টা থেকেই র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির শত শত সদস্য এ পথে কয়েক স্তরে ব্যারিকেড তৈরি করে। এ সময় কোথাও কোনো গাড়ি-রিকশা এমনকি সংবাদকর্মীদেরও দাঁড়াতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অথচ তাদের সামনে দিয়েই দফায় দফায় মিছিল করছিল সরকারি দলের লোকেরা। কিছুক্ষণ পর পর ২০-২৫টি মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। আবদুল্লাপুর ফুটওভার ব্রিজের নিচে এ সময় দু’টি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এ সময় আবদুল্লাপুরের অদূরে অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের সমর্থনে একটি নির্বাচনী জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
কাঁচপুরে রোগীকেও আটকে দেয় যৌথবাহিনী : সকাল ৮টায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকা থেকে একটি মাইক্রোতে অসুস্থ এক ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য পরিবারের লোকজন নিয়ে আসছিলেন ঢাকায়। কয়েক দফা তল্লাশির পর গাড়িটি কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছার পর মাঝপথে যৌথবাহিনীর সদস্যরা আটকে দেয়। গাড়ির ভেতরে থাকা এক যুবক বের হয়ে জানালেন গাড়িতে অসুস্থ লোক আছে, তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। যৌথবাহিনীর সদস্যরা যুবকটির কোনো কথা শুনলেন না। এমনকি গাড়িতে আসলেই কোনো অসুস্থ লোক আছে কি না তা-ও যাচাই করলেন না। যুবকটিকে বলা হলো যে দিক থেকে এসেছ সে দিকে যাও, নইলে রাস্তায় কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখব। কোনো উপায় না দেখে যুবকটি পেছনে ফিরে গিয়ে বিকল্প রাস্তা খুঁজছিলেন। কিন্তু সবখানেই একই অবস্থা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবকটি জানালেন, গাড়িতে অসুস্থ লোকটি তার ভগ্নিপতি। রাত থেকে বুকে ব্যথা অনুভব করছেন, তাই স্থানীয় চিকিৎসকরা ঢাকায় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন। পথে কয়েক দফা র্যাব-পুলিশের তল্লাশির মুখে পড়লেও গাড়িতে অসুস্থ লোক দেখে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু কাঁচপুর ব্রিজে এসে যৌথবাহিনীর বাধার মুখে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তিনি স্থানীয় কোনো কিনিক খোঁজ করছিলেন।
বেলা ১টায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে রোগী নিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে সাইনবোর্ড এলাকায় পৌঁছেন। চেকপোস্টে যৌথবাহিনীর সদস্যরা সাথে সাথে অ্যাম্বুলেন্সটি আবার নারায়ণগঞ্জের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। চালক বা রোগীর লোকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে কোনো কথা বলার সুযোগ পেলেন না বরং অ্যাম্বুলেন্স চালককে লাঠি হাতে তেড়ে যান এক এপিবিএন সদস্য।
এভাবে রাজধানীতে অন্যতম প্রবেশদ্বার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর ব্রিজ ও ঢাকা-সিলেট সড়ক কার্যত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেষ্টনীতে ছিল। সারা দিনে এই সড়ক দিয়ে অন্যান্য যানবাহন দূরের কথা, একটি অ্যাম্বুলেন্সও ঢাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। জরুরি কাজে বা অফিসমুখো মানুষ ঢাকায় রওনা হয়ে পথে পথে তল্লাশির মুখে পড়েছেন। হেঁটে বা বিকল্প ব্যবস্থায় রওনা হওয়া এসব সাধারণ মানুষের অনেককেই গন্তব্যে যেতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কাউকে আবার সন্দেহ হলে পথে বসিয়ে রেখেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
ভোর থেকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের কাঁচপুর ব্রিজ ও ঢাকা-সিলেট সড়কের সুলতানা কামাল সেতুতে অবস্থান নেয়। এ ছাড়া কাঁচপুর ব্রিজের দুই প্রান্তে সেনাবাহিনী টহল দেয়। ব্রিজের দুই প্রান্তে এবং সাইনবোর্ড মোড়ের দুই পাশে বালুর বস্তা দিয়ে বাঙ্কার স্থাপন করে ডিউটি করে সেনাসদস্যরা।
পোস্তগোলা : রাজধানীর পোস্তগোলায় বুড়িগঙ্গা সেতুর দুই প্রান্তে ভোর থেকে অবস্থান করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শত শত কর্মজীবী নারী-পুরুষ আটকা পড়েন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে। এ সময় অনেকেই তাদের পরিচয়পত্র এবং কর্মস্থলের ঠিকানা জানানোর পরও গন্তব্যে যেতে পারেননি। এভাবে সারা দিন আটকা পড়েন মানুষ। বুড়িগঙ্গায় নৌকার মাঝিদের পারাপার বন্ধ করে দেয়া হয়। শত শত মাঝি গতকাল সারা দিনে কোনো উপার্জন করতে পারেননি।
গাবতলী : প্রতিদিন যেখান থেকে দূরপাল্লার শত শত বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন আসা-যাওয়া করে, যেখান থেকে লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে যায় দেশের বিভিন্ন জেলায়, সেই গাবতলী আমিনবাজার ছিল যৌথবাহিনী, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দখলে। তাদের সামনে দিয়ে কোনো যানবাহন তো দূরে থাক সাধারণ মানুষ হেঁটেও ঢাকায় প্রবেশ করতে পারেননি। এমনকি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী বহনকারী স্টাফ বাসগুলোকেও। তাদের বলা হয়েছে, ‘আজ কারো অফিস করা লাগবে না। বাসায় চলে যান’। তবে আইডি কার্ড দেখিয়ে এবং জরুরি প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে কেউ কেউ ঢাকায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। কিছু রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করলেও সেগুলোকে তল্লাশির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘক্ষণ। যৌথবাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও পথচারীদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে হাত দিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে। গতকাল রোববার ভোর থেকে রাজধানীর গাবতলী বাসটার্মিনাল ও আমিনবাজার এলাকায় গিয়ে এসব চিত্র দেখা যায়। গাবতলী টার্মিনালের দিকে যেতে প্রথমেই মাজার রোডে চোখে পড়ে বিশাল আকারের প্যান্ডেল। সেখানে ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হকের নেতৃত্বে চলছে গানবাজানা ও বক্তৃতার অনুষ্ঠান। একটু সামনে এগোতেই চোখে পড়ে আরো একটি প্যান্ডেল। এখানেও চলছে গানবাজনার অনুষ্ঠান। দুটি প্যান্ডেলই ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আর একটু সামনে রয়েছে বিজিবির কয়েকটি টহল গাড়ি। এরপর আসে আমিনবাজার ব্রিজ। এই ব্রিজটি ঘিরেই যত নিরাপত্তা। ব্রিজের পশ্চিম পাশে অর্থাৎ আমিনবাজারের দিকে রয়েছে ঢাকা জেলা পুলিশের কয়েকটি ব্যারিকেড। এই ব্যারিকেড শুরু হয়েছে সাভার হেমায়েতপুর থেকে। সেখান থেকে একজন লোককে ঢাকার দিকে আসতে কমপক্ষে ১০টি স্থানে জিজ্ঞাসাবাদের শিকার হতে হয়েছে। তারপরও যারা এই ব্যারিকেড পেরিয়ে আমিনবাজার ব্রিজ পার হয়েছেন তারা পড়েছেন আরো বিপাকে। কারণ ব্রিজের পূর্ব পাশে রয়েছে যৌথবাহিনী ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের কড়া পাহারা। প্রথম স্তরে র্যাব-৪ এর বিপুলসংখ্যক সদস্য। এরপর রয়েছে পুলিশ। তারপর বিজিবি। এরপর ফাঁকে ফাঁকে অবস্থান করছে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা। ব্রিজের পাশেই বসানো হয়েছে পুলিশের ওয়াচ টাওয়ার। যেখানে বসে বাইনোকুলার দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে ওই এলাকার অবস্থা। ব্রিজের মুখে রাস্তার দুই পাশে বসানো হয়েছে কাঁটাতারের ব্যারিকেড। এতে করে রাস্তাটি সরু হয়ে এক লেনে পরিণত হয়েছে। এর দুই পাশে রয়েছে র্যাব ও পুলিশ অ্যাম্বুলেন্স সংবাদপত্রের গাড়ি বা মোটরসাইকেল যা-ই আসুক সব কিছু তল্লাশি করেছে যৌথবাহিনী। কথা শেষে যদি তারা মনে করছেন যে এই গাড়ি বা ব্যক্তিকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেয়া যেতে পারে তাহলে তাকে ঢাকায় ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। তা ছাড়া ওই গাড়ি বা ব্যক্তিকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। যারা ঢাকায় প্রবেশ করছেন তারা গাবতলী বাসটার্মিনাল, মাজার রোড, কল্যাণপুরসহ আরো কয়েকটি স্থানে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের শিকার হচ্ছেন। তবে সেগুলো যৌথ বাহিনীর নয়। সেগুলো ছিল সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের তল্লাশি। সোনালী ব্যাংকের এক কর্মচারী জানান, আমিনবাজার থেকে সোনালী ব্যাংকের কয়েকটি স্টাফ বাস ঢাকায় যায়। গতকালও বাসগুলো কর্মচারীদের নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। কিন্তু পথে আমিনবাজার থেকে ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। কারণ জানতে চাইলে পুলিশ বলে, ‘আজ কারো অফিস করা লাগবে না। বাসায় চলে যান। সরকার অফিস করে দেবে’। পরে কর্মচারীরা যার যার বাস থেকে নেমে বাসায় চলে যান। একইভাবে অন্য অফিসগুলোর স্টাফ বাসকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। মিরপুরের রাব্বী ফ্যাশনের মালিক রমিজ উদ্দিন জানান, তিনি কেরানীগঞ্জ থেকে মোটরসাইকেলে ঢাকায় প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু যৌথবাহিনীর কারণে ব্যর্থ হয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে আমিনবাজার আসেন। ভাবেন এখান দিয়ে যদি ঢাকায় প্রবেশ করা যায়। কিন্তু ঢাকা জেলা পুলিশ তাকে দুই ঘণ্টা বসিয়ে রেখে অবশেষে বাসায় ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কাওরানবাজার সামসাং শো-রুমের কর্মচারী তুষার দাস বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন আচরণ আগে কখনো দেখিনি। তারা হেঁটেও আসতে দিচ্ছে না। তিনি অনেক অনুরোধ করার পর আইডি কার্ড দেখে, নাম, বাবার নাম শুনে তারপর তাকে ঢাকা প্রবেশের অনুমতি দেয়। দুপুরের পর গরুবাহী কয়েকটি ট্রাক প্রবেশ করতে দেয়া হয়। এভাবেই চলতে থাকে গাবতলীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা।
নির্বাচন বন্ধ না করা পর্যন্ত রাজপথ রেলপথ নৌপথে অবস্থান
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ১৮ দলীয় জোটের ডাকা ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’ কর্মসূচি চলবে আজো। গতকাল পুলিশি বাধায় এ কর্মসূচির নেতৃত্ব দিতে পারেননি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গুলশানের বাসায় ‘অবরুদ্ধ’ করে রাখা হয়েছিল তাকে। বাসার মূল ফটকে দাঁড়িয়ে কঠোর ভাষায় সরকারের সমালোচনা করার পাশাপাশি কর্মসূচিও ঘোষণা করেন তিনি।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র রক্ষায় কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। আজো চলবে মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি।
এ দিকে সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস কাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তফসিল বাতিল এবং নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সারা দেশের সব থানা জেলা উপজেলা মহানগরে রাজপথ রেলপথ ও নৌপথে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন, ১৮ দলের প থেকে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা অব্যাহত থাকবে। আজো হবে এ কর্মসূচি। খালেদা জিয়া এই সমাবেশে নেতৃত্ব দেবেন। সমাবেশ সকাল ১০টায় শুরু হবে। বেগম জিয়া উপযুুক্ত সময়ে সমাবেশে উপস্থিত হবেন।
খালেদার জিয়ার ডাকে লোক আসেনিÑ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এমন বক্তব্যের জবাবে তার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তিনি বলেন, পুলিশ ও পেটোয়ো বাহিনী সরিয়ে আসুন, বিনা বাধায় দুই নেত্রীর ডাকে দুই দিন সমাবেশ হবে। তখন দেখা যাবে কার ডাকে বেশি লোক আসে। সুতরাং খালেদা জিয়ার ডাকে লোক আসেনি এটি পাগলের প্রলাপ মাত্র। সাহস থাকলে উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করুন।
দেশের জনগণ যে আওয়ামী লীগের পাশে নেই এটি জেনেই সরকার সংবিধান থেকে গণভোটের প্রথা বিলোপ করে দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন এই বিএনপি নেতা।
মেজর হাফিজ বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আমরা হতবাক হয়েছি। তার বক্তব্য নীতিবিবর্জিত। সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে তার এমন বক্তব্যে আমরা লজ্জিত হয়েছি। তার কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আমরা আশা করি না। শুধু অশালীন ভাষায় বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হেয় করাই এখন তাদের ল্য হয়েছে।
হাফিজ বলেন, পুরো জাতি দেখেছে কিভাবে খালেদা জিয়াকে আটকে রাখা হয়েছে। গাড়িতে উঠে যখন যেতে চেয়েছিলেন, তখন পুলিশ বাধা দিয়েছে। নিরস্ত্র ব্যক্তি কী করে পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে আসবেন? খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখায় সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ ুণœœ হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির এই নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার মদদে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা ন্যক্কারজনকভাবে প্রেস কাবে হামলা চালিয়েছে। জাতীয় প্রেস কাবে সরকারি সন্ত্রাসীদের এমন হামলার তীব্র নিন্দা জানাই।
তিনি বলেন, গুলি চালিয়ে সরকার বিুব্ধ জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তিনি বলেন, অযাচিতভাবে বিএনপিকে ক্যান্টনমেন্টের দল বলে অভিহিত করছে আওয়ামী লীগ নেতারা।
হাফিজ বলেন, এ সরকারের হাত রক্তে রঞ্জিত। পুলিশের গুলিতে চাঁদপুরের মুক্তিযুদ্ধা রাজ্জাক প্রধানীয়ার ছেলে মনসুর প্রধানীয়া আজ মালিবাগে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা শামীমুর রহমান শামীম ও জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু উপস্থিত ছিলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন