গ্রামবাংলায় এখনও কথাটা বেশ জোরেশোরেই শোনা যায়-‘পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে’। এই প্রবাদটা বেশ খাটে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের বেলায়। বয়স যতই বাড়ছে মাহমুদউল্লাহর তার পারফরম্যান্সের ধার যেন ততোই বাড়ছে। তিনি যে কেবল নিজে পারফরম্যান্স করছেন তা নয়; ২২ গজে সতীর্থদেরও পাঠ নিচ্ছেন। কঠিন পরিস্থিতিতে রান করে চাপ কাটানোর উপায় বাতলে দিচ্ছেন। যা অনুসরণ করে সিদ্ধহস্ত হচ্ছে তরুণ তানজিম হাসান সাকিব, জাকের আলীরা। আর আঁখেরে লাভটা হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের।
কীভাবে? চলুন সেই হিসেব মেলায়-
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে মাহমুদউল্লাহর বয়স এখন বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বয়স ৩৮ বছর ৩১৩ দিন। অর্থাৎ প্রায় ৩৯ ছুঁইছুঁই। যে কারণে এক দুই ম্যাচ খারাপ খেললেই তাকে শোনতে হয়- আর কত? এবার তো থামুন। এমন পরিস্থিতিতে মাহমুদউল্লাহও শেষ টানতে শুরু করেছেন। টেস্ট ছাড়ার পর সবশেষ ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টির পাঠ চুকিয়েছেন। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটটা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ নিয়েও অবশ্য কম কথা সইতে হচ্ছে না তাকে। নেহায়েত কঠিন ধাতু দিয়ে তৈরি বলেই হয়তো তিনি এসব অবলীলায় সহ্য করতে পারেন। কখনো গণমাধ্যমের সামনে এসে টু শব্দটি করেন না। নিন্দুকদের সমালোচনা করেন না। বরং সমালোচনাটাকে নিজের চলার পথের পাথেয় হিসেবে ধরে নিয়েই এগোচ্ছেন তিনি। সব প্রতিবন্ধকতা সত্যেও বয়সকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় না করিয়ে পারফরম্যান্সকেই শেষ কথা হিসেবে মেনে নিয়েছেন তিনি।
অথচ, এক দুই ম্যাচ খারাপ খেললেই সমর্থকদের একটা অংশ বলতে শুরু করেন এবার তো থামুন-
একজন ক্রিকেটার কোথায় থামবেন- সে স্বাধীনতা কিংবা সিদ্ধান্ত একান্তই তার। নির্বাচকদের কাজ পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করে দলে সুযোগ দেওয়া। আর ক্রিকেটারদের কাজ পারফর্ম করে দলে নিজের অবস্থান ধরে রাখা। অথচ, এই কথাটি সবার বেলায় এক থাকে না। কেউ কেউ এক দুই ম্যাচ রান না পেলেই রব উঠে আর কত? এবার থামুন-অথচ একই দোষে দোষী বাকিদের বেলায় তার ব্যতিক্রম।
তবে এসব যে গায়ে মাখেন না মাহমুদউল্লাহ তা তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। দল থেকে বাদ পড়লে কিংবা কারণ ছাড়াই তাকে দলের বাইরে রাখা হলেও যখনই সুযোগ পান পারফরম্যান্সটাকেই টিকে থাকার হাতিয়ার বানান মাহমুদউল্লাহ। মাঠে বুক চিতিয়ে লড়াই করেন। বাংলাদেশকে বার বার টেনে তুলেন।
এক সিরিজ আগে তাকানো যাক। আফগানিস্তান সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে খুব একটা রান পাননি মাহমুদউল্লাহ। যে কারণে অনেকেই তার ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন। সামাজিক মাধ্যমে হচ্ছিল সমালোচনা। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে বাদ দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছিল। তৃতীয় ম্যাচে মাহমুদউল্লাহ জানান দেন- তিনি এখনও রান করতে ভুলেননি। ধুকতে থাকা একটা দলকে টেনে তুলেছিলেন সে ম্যাচে ৯৮ রানের ইনিংস খেলে।
এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে তো তিন ম্যাচেই ফিফটি প্লাস ইনিংস খেলেছেন। এর মাঝে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে দল যখন সবচেয়ে বেশি ধুঁকছে। ১১৫ রানের মাঝে হারিয়ে বসেছে ৭ উইকেট। তখন হাল ধরেন মাহমুদউল্লাহ। তরুণ তানজিম সাকিবকে নিয়ে দলকে একটা লড়াই করার মতো পুঁজি পাইয়ে দেন ৬২ রানের ইনিংস খেলে।
হ্যাঁ, আপনি ওই ম্যাচে তার স্ট্রাইক রেট নিয়ে কথা বলতে পারেন। তবে, যেখানে দেড়শ রানের আগে অলআউট হওয়ার শঙ্কা ঝেঁকে বসে; সেই দলকে ২২৭ রানের চ্যালেঞ্জি পুঁজি পাইয়ে দেওয়ার পর তার স্ট্রাইক রেট নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর।
মাহমুদউল্লাহ যে কেবল নিজে ওই ম্যাচে দারুণ ব্যাট করেছেন তা নয়। তরুণ তানজিম সাকিবকে শিখিয়েছেন কীভাবে টিকে থাকতে হয়। কোন বল ছাড়তে আর কোন বল মারতে হয়। কোন পরিস্থিতিতে কেমন ব্যাট করতে হয়। সাকিবও যেন সেটিই করে দেখিয়েছেন ক্যারিয়ার সেরা ৪৫ রানের ইনিংস খেলে। আর যখন সাকিব আউট হয়েছেন তখন মাহমুদউল্লাহ দৌড়ে গিয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের কাছে যা চান আপনি। শুধু পারফরম্যান্স আদায় করায় নয়; অভিবাবকের মতো তাকে আগলে রাখা।
তৃতীয় ম্যাচেও সেই ধারা অব্যাহত রাখলেন মাহমুদউল্লাহ। খেললেন অপরাজিত ৮৪ রানের একটা ইনিংস। শুধু নিজে নয় সতীর্থ জাকেরকে দিয়েও খেলালেন। পরিস্থিতি বুঝে ব্যাট চালালেন। আর তাতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে রেকর্ড ৩২১ রানের পুঁজি পেল বাংলাদেশ। যদিও দিনশেষে হারতে হয়েছে বাংলাদেশকে। তবে সিরিজ সর্বোচ্চ ১৯৬ রান মাহমুদউল্লাহর নামের পাশে।
সিরিজ হারলেও তাই মাহমুদুল্লাহর প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেননি অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ। এখনও মাহমুদউল্লাহ যে বাকিদের শেখায় সেটাও জানিয়েছেন মিরাজ। তিনি বলেন, ‘মাহমুদউল্লাহ খুব ভালো করেছেন। এই সিরিজে তিনি তিনটি ফিফটি পেয়েছেন। এটা আমাদের দলের জন্য ভালো মুহূর্ত। আমরা তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি। এই সিরিজে তরুণদের দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ ছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা তা করতে পারিনি।’
এমন পারফরম্যান্সে মাহমুদউল্লাহ জানান দিলেন, তিনি আসলে দলের বোঝা নন; বয়স বাড়লেও পারফরম্যান্সে ধার কমেনি তার। এখনও তার চাওড়া কাঁধ বাংলাদেশ দলকে টানতে জানে। এখনও তিনি আছেন ওয়ানডেতে। ভাঙা কুলোর মতো প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাকে যেন ছুড়ে ফেলা না হয়। কেননা, ভাঙা কুলোও ছাই ফেলতে কাজে লাগে। আর মাহমুদউল্লাহ তো পুরোনো চাল, যা ভাতে বাড়ে। সঙ্গে স্থায়িত্বটাও হয় অনন্য নতুনদের চেয়ে অনেক বেশি। তাই মাহমুদউল্লাহকে ছেটে ফেলার বদলে না হয় তিনি থাকতে থাকতে না হয়, নতুনদের প্রস্তুত করুণ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন