Image description
এস আলমের হুমকি, আন্তর্জাতিক সালিশির মানে কী?
বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলমের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ওরফে এস আলম বিনিয়োগ ‘ধ্বংসের’ অভিযোগে এনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এস আলমের দাবি, শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার তার সম্পদ জব্দ এবং বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে; এই ক্ষতি আদায়ের জন্য তিনি আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্যান্য উপদেষ্টাদের কাছে একটি বিরোধ নিষ্পত্তির নোটিশ পাঠিয়েছেন এস আলমের আইনজীবীরা। নোটিশে বলা হয়েছে, দুপক্ষ ছয় মাসের মধ্যে সমাধান না করতে পারলে তারা আন্তর্জাতিক সালিশি কার্যক্রম শুরু করবেন। ধারণা করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশ থেকে পাচার করা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে হুমকিতে ফেলতে পারে এস আলমের এই পদক্ষেপ। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তির আওতায় এস আলমের আইনজীবীরা এই আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন। ১৮ ডিসেম্বর পাঠানো নোটিশে বলা হয়েছে, এস আলম পরিবার ২০১১ সালে সিঙ্গাপুরের পার্মানেন্ট রেসিডেন্স (স্থায়ী বসবাস) এবং ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশটির নাগরিকত্ব পেয়েছেন। এস আলমের পরিবারের সদস্যরা ২০২০ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয় এতে। বাংলাদেশের আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এস আলমের নোটিশ অনুযায়ী ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার তার সাথে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাবে সাড়া না দিলে তিনি ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল কিংবা তার সাথে বাংলাদেশ সরকারের সম্পাদিত চুক্তিতে তৃতীয় কোনো দেশের আরবিট্রেশন সেন্টারের কথা উল্লেখ থাকলে সেখানে যেতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ বলেন, বাংলাদেশ সাড়া না দিলে তিনি একাই ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন। সেখানে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের আইনজীবীরাও বলার সুযোগ পাবেন যে এস আলম গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে কীভাবে অর্থ পাচার করেছে। প্রসঙ্গত, গত অক্টোবরে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন এস আলম গ্রুপ প্রায় এক হাজার কোটি ডলার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরিয়েছে। বাংলাদেশের একটি আদালত ইতোমধ্যেই সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ১২৫টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করেছে। আন্তর্জাতিক সালিশির মানে কী? সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সময় সম্ভাব্য বিরোধ নিষ্পত্তি কীভাবে হবে সেটি বিনিয়োগ চুক্তিতে উল্লেখ থাকে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত যাতে আসে, সেজন্য চুক্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তৃতীয় কোনো দেশের আরবিট্রেশন কোর্ট বা সেন্টারের নাম থাকে। আবার ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল আছে নেদারল্যান্ডসের দ্যা হেগ শহরে। এক দেশের সাথে আরেক দেশের কিংবা দেশের সঙ্গে বিদেশি কোম্পানির কিংবা বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে তারা ট্রাইব্যুনালে যেতে পারে। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বিনিয়োগ চুক্তিতে আরবিট্রেশনের প্রভিশন থাকলে সিঙ্গাপুরের কোনো নাগরিক বা নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে আরবিট্রেশন বা সালিশির প্রস্তাব দিতে পারে।কিন্তু দুই দেশের বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তিতে তেমন কিছু না থাকলে এস আলমের নোটিশের আইনগত কোনো ভিত্তি থাকবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলছেন, দুই দেশের মধ্যে ট্রেড বা ব্যবসা বাণিজ্য বিষয়ে কোনো সমস্যা হলে কিংবা কোনো পক্ষ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম নীতির বাইরে গেলে তা নিয়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় প্রতিকার চাইতে পারে।এটা কোম্পানি টু কোম্পানি কিংবা কোম্পানি টু সরকার- উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিভিন্ন দেশের আরবিট্রেশন কোর্টগুলো আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে এসব বিরোধ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলছেন, আরবিট্রেশন কোর্টে বাংলাদেশ সরকার অংশ নিলে তাতে যে সিদ্ধান্ত বা রায় আসবে সেই রায় সবসময় মানার বাধ্যবাধকতা নেই।এ ধরনের সিদ্ধান্ত স্ট্রিক্টলি ইনফোর্স করা কিংবা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন। ধরুন একটা দেশের সাথে একটা কোম্পানির বিরোধ হলো। আরবিট্রেশনের সিদ্ধান্ত দেশের বিরুদ্ধে গেলো। কিন্তু সেই দেশ সেটি বাস্তবায়ন না করলে কী করার আছে! যদি বড় ধরনের কোনো চাপ আসে তখন আলাদা কিছু হতে পারে। তিনি বলেন, কোনো বিদেশি বাংলাদেশে আইন বহির্ভূত কিছু করলে তিনি বাংলাদেশের আইনের আওতায় চলে আসবেন। আবার কোনো বাংলাদেশি যদি অন্য কোনো দেশে গিয়ে অপরাধ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে সেই দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।অন্যদিকে, আরবিট্রেশনের রায় আপনার পক্ষে গেলেও দিন শেষে সেটা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। জাফরুল হাসান শরীফ বলছেন, এস আলমের নোটিশের জবাব যদি বাংলাদেশ সরকার না দেয় অর্থাৎ বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাবে যদি সায় না দেয় তাহলে এস আলম গ্রুপ একাই ট্রাইব্যুনালে যেতে পারে।সেখানে সরকার না গেলে তখন ট্রাইব্যুনাল একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেটা দেশের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই বরং সরকার জবাব দিতে সেখানে গিয়ে এস আলমের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের যে দাবি করে আসছে সেটি অভিযোগ আকারে তুলে ধরতে পারে। তার মতে সিঙ্গাপুর বা যুক্তরাজ্যের মতো দেশে অন্য কোনো দেশ থেকে অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ ভিন্ন পথে বিনিয়োগে আইনি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শরীফ বলেন, সে কারণে এস আলম ট্রাইব্যুনালে গেলে সেটি বাংলাদেশ সরকারের জন্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলার একটি সুযোগ নিয়ে আসতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী তার নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেছেন এস আলম গ্রুপ আরবিট্রেশনে গেলেও খুব একটা লাভ পাবে না বলেই মনে করছেন তিনি। কারণ আরবিট্রেশনের রায় কোনো পক্ষ বাস্তবায়ন না করলে কার্যত করার কিছুই নেই। কোনো বিদেশি বা বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা সরকারের কারণে তার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের আদালতেই তার প্রতিকার চাইতে হবে। প্রসঙ্গত, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছেন বলে তার নোটিশে উল্লেখ করেছেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী- বাংলাদেশ সরকারকে দেয়া নোটিশে বলা হয়েছে যে সাইফুল আলমের পরিবার ২০১১ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তারা সে দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। একই সাথে নোটিশে তারা জানিয়েছেন যে, সাইফুল আলম ও তার পরিবার ২০২০ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আহসান এইচ মনসুর এর আগে অক্টোবরে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সাইফুল আলম ও তার সহযোগীসহ অন্যরা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক দখল করে ব্যাংকিং খাত থেকে দেশের বাইরে অর্থ পাচার করেন। গভর্নর অভিযোগ করেন, ব্যাংকের নতুন শেয়ারহোল্ডারদের ঋণ প্রদান, আমদানি মূল্য বাড়িয়ে দেখানোর (ওভার ইনভয়েসিং) মতো পদ্ধতিতে এস আলম ও তার সহযোগীরা অর্থ পাচার করেছেন। একে তিনি যেকোনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সবচেয়ে বড় ও সর্বোচ্চ অঙ্কের ব্যাংক লুট বলে অভিহিত করেছেন। এস আলম গ্রুপ অবশ্য বলেছে, এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। খাদ্য, নির্মাণ, পোশাক, ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন খাতে গ্রুপটির ব্যবসা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন মুখপাত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, ইস্যুগুলো তদন্তাধীন। তদন্তের স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনই কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছে। সাইফুল আলমের চিঠি ইঙ্গিত দিচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য হাসিনার আমলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন হবে।