চট্টগ্রাম নগর ও গ্রামের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নেমে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ, নিয়ম না মেনে গভীর নলকূপ স্থাপন। পরিবেশবিজ্ঞানীরা ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে বারবার সতর্ক করছেন; কিন্তু চট্টগ্রাম ওয়াসা ১১০ কোটি টাকা খরচ করে এবার ৫৫টি গভীর নলকূপ বসাচ্ছে। এসব নলকূপ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার ৮২৫ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। নলকূপ বসানোর এ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ প্রকল্পের’ আওতায় এসব নলকূপ বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এ প্রকল্পের অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭২৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এতে অন্যান্য উন্নয়নকাজের পাশাপাশি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে।
গত আগস্টে প্রকাশিত ওয়াসার ব্যবস্থাপনা তথ্যপদ্ধতি প্রতিবেদন (এমআইএস) অনুযায়ী, বর্তমানে ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ ৮৩ হাজার ৭৫৪টি ও বাণিজ্যিক সংযোগ ৬ হাজার ৩০৪টি। ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের পানির দৈনিক উৎপাদন এখন ৪৫ থেকে ৫০ কোটি লিটার। তবে চাহিদা ৫৫ কোটি লিটার। অবশ্য উৎপাদনের ৩০ ভাগ পানি নিবন্ধিত গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় না। সিস্টেম লস বা কারিগরি অপচয়ের কারণে এসব পানি নষ্ট হয়। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ১৪ কোটি লিটার পানি হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারিগরি অপচয় কমানো গেলে নতুন করে গভীর নলকূপ বসানোর প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ওয়াসা দীর্ঘদিন ধরেই অপচয় কমাতে পারছে না। ঠেকাতে পারছে না পানি চুরি।
গভীর নলকূপের মাধ্যমে নিয়মিত পানি তুললে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামে পানির চাহিদা মেটাতে আরও একটি পরিশোধনাগার তৈরির উদ্যোগ তাঁরা নিয়েছেন। শিগগির এটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হবে। তবে এটি নির্মাণ ও ফল পেতে আরও অন্তত আট বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে গভীর নলকূপ থেকে পানি নিয়ে সরবরাহ করা হবে। পানি শোধনাগার নির্মিত হয়ে গেলে কিছু গভীর নলকূপ বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বর্তমানে ওয়াসার ৫০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে নগরের শেরশাহ এলাকায় একটি গভীর নলকূপ বসানো হয়। এতে ব্যয় হয় ৭০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে নলকূপ থেকে প্রতিদিন প্রায় চার কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা যায়। বাকি পানি আসে হালদা ও কর্ণফুলী নদী থেকে। এ ছাড়া নগরে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ওয়াসার অনুমোদিত গভীর নলকূপ রয়েছে ৪ হাজার ২০০টি। এর বাইরে অনুমোদন ছাড়া অন্তত ২০ হাজার গভীর নলকূপ রয়েছে বলে ওয়াসার রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
কালুরঘাটেই বসবে ৪০টি নলকূপ
এখন নতুন ৫৫টি নলকূপ বসালে প্রতিদিন পাঁচ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করা যাবে। এর মধ্যে এক কালুরঘাট এলাকাতেই বসবে ৪০টি নলকূপ। বাকিগুলো নগরের বিভিন্ন এলাকায় বসানো হবে।
ওয়াসার তথ্যমতে, কালুরঘাটে বর্তমানে ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল (গভীরতা) ৪৫ ফুট। অর্থাৎ পানি পেতে হলে ৪৫ ফুটের বেশি খুঁড়তে হবে। এক দশক আগে স্থিতিতল ছিল ২৮ ফুট। এ এলাকাতেও স্তর নিচে নামছে।
কালুরঘাটে ৪০টি নলকূপ বসানোর বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ওই এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল এখনো ভালো। ৪৫ ফুট গভীরতায় পানি পাওয়া যায়। এ কারণেই ওই এলাকায় ৪০টি গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে।
ক্রমেই নামছে পানির স্তর
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাওয়া নিয়ে গবেষণায় উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম নগরের ১০টি এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল ছিল গড়ে ২৪২ ফুট। আর এখন একই এলাকায় পানি পেতে হলে খুঁড়তে হবে ৩১০ ফুট। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে নগরে এলাকাভেদে প্রতিবছর ছয় ফুট করে পানির স্তর নিচে নামছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরে কংক্রিটের অবকাঠামোতে খোলা জায়গা ঢাকা পড়ছে। আবার ব্যক্তিগতভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করে পানি তোলা হচ্ছে। এসব কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে। ওয়াসার তথ্যমতে, ২০১৪ সালে নগরের ১০টি এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল ছিল গড়ে ২৪২ ফুট। ২০২৪ সালে ওই একই এলাকার স্থিতিতল ৩১০ ফুট। অর্থাৎ এক দশকে ৬৮ ফুট নেমেছে পানির স্তর।
২০১৮ সালে চুয়েটের একদল গবেষক নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল নিয়ে প্রকল্পভিত্তিক গবেষণা করেন। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ কুমার পাল। ১৯৬৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের তথ্য নিয়ে তাঁরা ওই গবেষণা করেন। গবেষণার বিষয়ে সুদীপ কুমার পাল প্রথম আলোকে জানান, বর্তমানে এলাকাভেদে প্রতিবছর ২ মিটার বা সাড়ে ৬ ফুট করে পানির স্তর নিচে নামছে। তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহারে মাটি বসে যায়। সারা বিশ্বেই ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আবার ওয়াসার যে পরিমাণ পানি নষ্ট নয়, তা অগ্রহণযোগ্য। ওয়াসারও কারিগরি অপচয় কমিয়ে আনা গেলে গভীর নলকূপ বসানোর প্রয়োজন হতো না।