দেশের অর্ধ শতাধিক জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে যে বিতর্কের সূচনা হয়েছে, তা এখনো সুরাহা হয়নি। এই বিতর্কের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের দুই যুগ্ম সচিব কে এম আলী আযম ও ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ।
ডিসি পদে নিয়োগপ্রত্যাশী বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের ডিসি বানানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এপিডি অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব ড. কে এম আলী আযম মুল ভূমিকা রেখেছেন।
গত ১০ সেপ্টেম্বর ডিসি নিয়োগের দুটি প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে এই দুই যুগ্ম সচিবকে কক্ষে অবরুদ্ধ করেছিলেন বঞ্চিত কর্মকর্তারা। নজিরবিহীন ওই ঘটনার এক সপ্তাহ পর দুই যুগ্ম সচিবের বিষয়ে বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে দেখা করছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তার কক্ষে মঙ্গলবার বেলা ১১টায় বিক্ষুব্ধ বঞ্চিত কর্মকর্তারা সিনিয়র সচিবের সঙ্গে দেখা করবেন। ডিসি নিয়োগে দুই যুগ্ম সচিবের কেলেঙ্কারির বিষযে গৃহীত সিদ্ধান্ত নিয়ে সিনিয়র সচিবের সঙ্গে এ সাক্ষাত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ঢাকা টাইমসকে নিশ্চিত করেছে।
খোঁজ নিয়ে ঢাকা টাইমস জানতে পেরেছে, কে এম আলী আযম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর উইংয়ে বসার পর থেকেই তাকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে জনপ্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ক্ষোভে ফুঁসতে থাকেন।
এর কারণ, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী তিনজন আমলা, যারা বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন, আলী আযম তাদের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে কাজ করেছেন।
ফলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আলী আযমের বর্তমান কর্মকাণ্ডকে ভালো চোখে দেখছেন না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা চান এমন অনেক সাবেক আমলা।
খোঁজ নিয়ে ঢাকা টাইমস জেনেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বর্তমান চেয়ারম্যান মঈনুদ্দীন আবদুল্লাহ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যখন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন, তখন বিসিএস প্রশাসন ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা আলী আযম তার ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) ছিলেন।
ঢাকা টাইমস নিশ্চিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেনের ব্যক্তিগত সচিবও ছিলেন আলোচিত যুগ্ম সচিব আলী আযম। এমনকি প্রশাসন ৮৪ ব্যাচের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ও আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম সুবিধাভোগী সাবেক সমাজসেবা সচিব জিল্লার রহমানেরও স্নেহধন্য ছিলেন আলী আযম।
একাধিক সূত্র ঢাকা টাইমসকে জানায়, সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা প্রত্যাশী জিল্লার রহমান ঢাকার জেলা প্রশাসক থাকার সময় এখনকার আলোচিত যুগ্ম সচিব আলী আযম ঢাকার আরডিসি ছিলেন। সাধারণত, আরডিসিকে জেলা প্রশাসকের আস্থাভাজন কর্মকর্তা বিবেচনা করা হয় সব সময়।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের তিনজন ঘনিষ্ঠ সচিবের সাহচর্যে থাকা একজন কর্মকর্তা কোন যুক্তিতে মাঠপ্রশাসনের মতো স্পর্শকাতর ডেস্কের যুগ্ম সচিবের দায়িত্ব পেলেন? ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন জনপ্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা।
বগুড়া জেলায় বাড়ি এবং যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছিলেন— মূলত এই দুই বিষয়কে হাতিয়ার করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আলী আযম দ্রুত পদোন্নতি বাগিয়ে নেন।
আলী আযমের বিষয়ে এমন তথ্য দিয়ে জনপ্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো ঢাকা টাইমসকে জানাচ্ছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এমন প্রচারকে কাজে লাগিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন নিশ্চিত করেন যুগ্ম সচিব আলী আযম।
সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সদস্য সচিব হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মাঠ প্রশাসন) এর ভূমিকা কতটা প্রকৃত সংস্কারের পক্ষে হবে আর কতখানি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে হবে তা সম্প্রতি জেলা প্রশাসক পদায়নেই অনেকখানি পরিস্কার হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা টাইমসকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্রলীগ মনোভাবাপন্ন যেসব উপসচিব ইতোমধ্যে ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন এবং ডিসি ফিটলিস্টে আছেন তাদের পেছনে মূল খুঁটি হিসেবে কাজ করছেন আলী আযম। এই অভিযোগ শতভাগ সত্য না-কি আংশিক সেটি প্রমাণের চেয়েও জরুরি হচ্ছে আলী আযমকে অবিলম্বে গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে অন্যত্র পদায়ন করা। ঢাকা টাইমসের সঙ্গে এমনটাই মত দেন দায়িত্বরত একজন সচিব।
তিনি বলেন, কানাঘুষা আছে যুগ্ম সচিব আলী আযম একটি বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষে মাঠ প্রশাসন গোছাতে অতি সক্রিয় আছেন। এমনকি বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতি, পদায়ন বঞ্চিত কর্মকর্তা নিজের দুরবস্থা জানাতে গিয়ে আলী আযমের কক্ষে হেনস্থা, দুর্ব্যবহারের শিকার হচ্ছেন।
এদিকে যুগ্ম সচিব আলী আযম বগুড়ার ছেলে হিসেবে বিএনপি ঘনিষ্ঠ বলে যে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছেন সেটিও যথার্থ নয় বলে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সূত্রে যোগাযোগ করে ঢাকা টাইমস নিশ্চিত হয়েছে।
আলাপকালে একজন সচিব ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আলী আযমের মতো বিতর্কিত কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসনের এমন স্পর্শকাতর জায়গায় পদায়ন রাখা কোনো মতেই সমীচীন নয়। এই পদে যিনি থাকবেন তাকে অবশ্যই সংস্কারের পক্ষের লোক হতে হবে।’
‘যেহেতু তিনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অতি ঘনিষ্ঠ তিনজন সচিবের একান্ত সচিব ছিলেন, তাই যুগ্ম সচিব আলী আযমকে জনপ্রশাসনের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে ভালো কিছু আশা করা যাবে না।’
এর জেরই দেখা যায গত ১০ সেপ্টেম্বর। ডিসি নিয়োগ নিয়ে নজিরবিহীন ওই হট্টগোলে এতদিন ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত উপসচিব পদমর্যাদার ৫০-৬০ কর্মকর্তা, যারা ডিসি হতে পারেননি, তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ (এপিডি) শাখায় যুগ্ম সচিব আলী আযমের কক্ষে গিয়ে দিনভর হইচই-হট্টগোল করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের কেন ডিসি করা হলো, সে বিষয়ে যুগ্ম সচিব আলী আযমের কাছে জানতে চান পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা। এক পর্যায়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবের আশ্বাসের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের ফিটলিস্ট থেকে ডিসি নিয়োগ হওয়ার যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা এখনো সুরাহা হয়নি। এ বিষয়ে এতদিন ধরে বঞ্চিত ও ডিসি পদে নিয়োগপ্রত্যাশী বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা বিক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেসুর রহমানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, প্রশাসন ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা কে এম আলী আযম সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে পদোন্নতি পেয়ে ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের মধ্যে গত ১৯ আগস্ট তিনি একই মন্ত্রণালয়ের (এপিডি উইংয়ে) যুগ্ম সচিবের দায়িত্ব নেন।
ঢাকাটাইমস