আগে কাঠামো পরে দলের চিন্তা
এই মুহূর্তে ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের প্রায় সব ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে। সেসব ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। ফ্যাসিস্ট সরকার প্রত্যেকটি ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ মানুষকে তাদের ফ্যাসিস্ট চিন্তাভাবনা, ক্ষমতার অপব্যবহার দিয়ে প্রভাবিত করেছে। মানুষের মন, চিন্তাভাবনা ও মগজ থেকে সেই ফ্যাসিস্ট চিন্তাগুলো বের করে দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য আমাদের যে কাজগুলো করা প্রয়োজন, সেগুলো মানুষের ভেতরে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত জায়গা থেকে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের জন্য যে উদ্যোগগুলো নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলো ব্যক্তিগত জায়গা থেকে নিতে হবে। পাশাপাশি ১৬ বছরে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, সেটি পূরণের জন্য নির্দিষ্ট একটা সময়ের প্রয়োজন। সেই সময়টুকু অন্তর্বর্তী সরকার, রাষ্ট্রসহ সবাইকে দিতে হবে। ওই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : সরকার পতনের পর রাষ্ট্র কাক্সিক্ষত সফলতা পেতে শুরু করছে কি না?
সারজিস আলম : ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মাত্র এক মাস হয়েছে, আমরা আমাদের জায়গা থেকে প্রত্যাশা করি, এই মুহূর্তে যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো সমাধানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কাজ শুরু করবে বা করছে। যদি করে বা করার চেষ্টা শুরু করে, তাহলে আমরা মনে করব যে এ সরকারের মাধ্যমে বা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। আমাদের যে স্বপ্ন সেটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে এবং এটির সফলতা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এটি আমরা অন্তত কয়েক বছর পর চিন্তা করতে পারব বা তুলনা করতে পারব যে গণ-অভ্যুত্থানের দিনের সঙ্গে আজকের দিনের পার্থক্য কতটুকু। এক মাসে এই তুলনা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
দেশ রূপান্তর : সেই সাফল্য পেতে ছাত্রদের ভূমিকা কেমন থাকবে?
সারজিস আলম : কাক্সিক্ষত সাফল্য পেতে ছাত্র-জনতা সব সময় একটি ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারসহ রাজনৈতিক যে গোষ্ঠীগুলো রয়েছে, তারা ক্ষমতার অপব্যবহার হয়, অপকর্ম হয়, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে সিন্ডিকেট এই কাজগুলোকে প্রশ্ন করবে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে জবাবদিহি চাইব এবং একটি ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে অবশ্যই ছাত্র-জনতা রাজপথে কাজ করবে।
দেশ রূপান্তর : আপনি বলছেন ছাত্ররা রাজপথে থাকবে। কিন্তু এর একটি ঝুঁকিও আছে।
সারজিস আলম : হ্যাঁ, সে বিষয়ে আমরা অবগত। শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রের একটি অস্থিতিশীল সময়ে যখন প্রয়োজন ছিল, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তারা এই কাজগুলো করেছে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো রক্ষা করেছে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, এখন এই দায়িত্বগুলো যাদের, তারা খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে বুঝে নেবেন এবং আমাদের সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে যে দায়িত্ব সেটি যদি আমরা পালন করা শুরু করি, তাহলে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রত্যাশা আমরা করি, সেই প্রত্যাশিত স্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা পাব। আমরা চাই, পুলিশ বাহিনী তাদের জায়গা থেকে কাজ করুক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে তাদের যেটি দায়িত্ব তারা সেটি পালন করুক। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তারা পুরোদমে মাঠে কাজ করবে। শিক্ষার্থীদের যে প্রধান কাজ পড়াশোনা করা, তারা সেটিতে মনোনিবেশ করবে।
দেশ রূপান্তর : রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া ‘যৌক্তিক’ সময়কে আপনারা কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
সারজিস আলম : ‘যৌক্তিক’ সময় বলতে আমরা বুঝি যতটুকু সময় রাষ্ট্রের কাঠামো সংস্কার করে গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। যার মাধ্যমে জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত একটি সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবে এবং এর জন্য শুধু নির্বাচন কমিশন সংস্কার করলেই যে হবে, ব্যাপারটি এমন নয়। রাষ্ট্র যদি একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আসে এবং নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার মতো অবস্থা তৈরি হয়, তখনই অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা তুলে দিতে পারে।
দেশ রূপান্তর : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চূড়ান্ত বিজয় কি না?
সারজিস আলম : যে স্পিরিট নিয়ে এই ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, সেই স্পিরিটগুলো, সেই লক্ষ্যগুলো, সেই উদ্দেশ্যগুলো যখন আমার সামনে দৃশ্যমান হবে কিংবা অধিকাংশ প্রত্যাশা যখন পূরণ হবে, তখনই আসলে আমরা বিজয়ের পথে যাব এবং এটিকে আমরা চূড়ান্ত বিজয় বলে গণ্য করতে পারব। আমরা ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানকে বিজয়ের প্রথম ধাপ বলছি। এরপর রাষ্ট্রের সংস্কার যদি করতে পারি, যে প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থাগুলোর ওপর জনগণ আস্থা হারিয়েছে, ১৬ বছরে সেগুলো সংস্কার করতে পারলে আমরা আরেকটি ধাপে যাব এবং পরে আমরা যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে, জনগণের আস্থার নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন একটি সরকারের হাতে, জনগণের সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে পারি, তখনই এটি বিজয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বারে উপনীত হবে।
দেশ রূপান্তর : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে, এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
সারজিস আলম : আসলে এই মুহূর্তে প্রত্যেকটি জেলায় আমাদের যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে একদম ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, তাদের নিয়ে আমরা একটি স্ট্রাকচার (কাঠামো) করতে চাই। এটি করার মূল কারণ হচ্ছে, আমরা দেখছি বিভিন্ন জায়গায় সমন্বয়ক, সহ-সমন্বয়ক এই নামগুলোকে ভাঙিয়ে অনেকেই বিভিন্ন অপচেষ্টা করছে কিংবা এমন অনেক কাজ করছে, যেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ কিংবা আমাদের চেতনার সঙ্গে যায় না, স্পিরিটের সঙ্গে যায় না। আমরা যদি একটি স্ট্রাকচার করতে পারি, তাহলে অন্তত যারা এই ভুয়া সমন্বয়ক রয়েছেন, তাদের আমরা খুব সুনির্দিষ্টভাবে সামনে নিয়ে আসতে পারব এবং তাদের প্রশাসনিকভাবে বা আইনগতভাবে বিচারের আওতায় আনতে পারব। আমরা বিশ্বাস করি, অন্তর্বর্তী সরকারকে হোক কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ যারা আজকে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় রয়েছেন, তাদের প্রশ্ন করার জন্য হলেও, আমরা এই স্ট্রাকচারের জায়গা থেকে প্রশ্ন করতে চাই এবং যারা এই আন্দোলনটিতে সক্রিয়ভাবে ছিলেন, ওতপ্রোতভাবে ছিলেন এবং সাংগঠনিকভাবে এই আন্দোলনকে সামনের দিকে নিয়ে গিয়েছেন, আমরা মনে করি, এই একটি স্ট্রাকচার তাদের একটি স্বীকৃতিও বটে। এরপর বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা যদি চান যে বাংলাদেশে আরেকটি নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন আছে, তখন ছাত্র-জনতার চাওয়ার ভিত্তিতে আমরা বিবেচনা করব, আমরা এমন কিছু একটা করতে পারি কি না।