একরাতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের, পরিবার কি সন্ধান পাবে এখন?
৪ ডিসেম্বর ২০১৩ নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলনে উত্তাল সারা দেশ। তখন ঢাকায় র্যাব ১-এর অধিনায়ক কিসমত হায়াতের নেতৃত্বে এক রাতের অভিযানে তুলে নেওয়া হয় বিএনপি ও ছাত্রদলের ৮জন নেতাকর্মীকে। দিনটি ছিল ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর। আজ ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু তাদের সন্ধান এখনো মিলছে না। পরিবার এখনও আছেন অপেক্ষায়। তবে র্যাব-১ এর তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার কিসমত হায়াত চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে আরাম আয়েশে জীবনযাপন করছেন। তার তত্ত্বাবধানেই মানবতাবিরোধী জঘন্য এই কাজ সম্পন্ন করে ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া র্যাব।
অথচ, মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত এই সেনা অফিসারের নামটাই এখন মানুষ ভুলে গেছেন। কিন্ত ভিকটিম পরিবারের সদস্যরা কি আর ভুলতে পারেন সেই নাম!
গুমের শিকার এই ৮ ছাত্রদল ও বিএনপি নেতাকর্মীর পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য থেকে উঠে এসেছে কিসমত হায়াতের নাম।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, একরাতে ৮ জনকে তুলে নিয়ে গুম করা হলেও আওয়ামীপন্থী মিডিয়া সেই খবরটি তখন তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। বরং ঘটনা ধামাচাপা দিতেই দেখা যায় আওয়ামীপন্থী পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল গুলোকে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের সহায়ক র্যাবের এই মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত অফিসারদের বিষয়ে আওয়ামী মিডিয়াও নীরব। আওয়ামী মিডিয়া এসব খুনি ও মানবতা বিরোধী অপরাধী অফিসারদের নাম নিতে যেন লজ্জা পায়। এই গুম-খুনের জন্য আওয়ামী মিডিয়া গুলো কম দায়ী নয়। অনেক মিডিয়া জেনে শোনে এসব গুমের ঘটনাকে এড়িয়ে গেছেন অথবা খুবই লো প্রোফাইলে প্রকাশ করেছে, যাতে মানুষের চোখে না পড়ে।
আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের দালালি করার জন্য অনেক সাংবাদিককে গড়ে তোলা হয়েছে। বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা ও ব্যবসা-পাতি দেওয়ার ফলে সামনের কাতারের অনেক সাংবাদিক এখন আওয়ামী লীগের অনুগত দলদাসে পরিণত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের দলদাস হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক নামধারী এই লোক গুলো প্রকৃত গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করছে। আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুম ও তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে।
যেভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাদেরকে:
ঢাকা মহানগরের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম ওরফে সুমন (৩৪) ছিলেন বিএনপির অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। নিজ দলের কাজ ছাড়াও এলাকার সাধারণ মানুষের বিপদে-আপদে ছুটে যেতেন নি:স্বার্থভাবে। সাজেদুলের বাসা শাহীনবাগ এলাকায়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জীবনের সংশয়ে নিজ বাসা ছেড়ে আশ্রয় নেন বসুন্ধরায় এক আত্মীয়ের বাসায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা বেগম (৭৬) বলেন, নির্বাচনের আগে জীবননাশের শঙ্কায় সাজেদুল বিভিন্ন আত্মীয়ের বাসায় থাকতেন। যে রাতে তাকে র্যাব ধরে নিয়ে যায়, সেই রাতে সে বসুন্ধরার আই-ব্লকে খালার বাসায় ছিলেন। ওই খালার একটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছিল।
মা হাজেরা বেগম বলেন, ওই ভবনের নিচে ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে সাজেদুল, তার খালাতো ভাই জাহিদুলসহ ছয়জন মুড়ি ও চানাচুর খাচ্ছিলেন। তখন সেখানে এসে থামে র্যাব-১ এর একটি গাড়ি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, র্যাব-১ লেখা তিনটি গাড়ি এসে থামে। সাথে ছিল আরো কয়েকটি গাড়ি। সবার পরনে ছিল কালো পোশাক। অস্ত্রধারীদের কয়েকজন ভবনটির সামনে এসে সশব্দে জানতে চায় ‘তোমাদের মধ্যে কার নাম সুমন?'
এ সময় সাজেদুল ইসলাম সুমন নিজের পরিচয় দেন। সাথে সাথে সুমন, তার খালাতো ভাই জাহিদুল করিম ওরফে তানভীরসহ (৩০) ছয়জনকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায় ওই বাহিনী।
বাকি চারজন হলেন পূর্ব নাখালপাড়ার বাসিন্দা আবদুল কাদের ভূঁইয়া ওরফে মাসুম (২৪), পশ্চিম নাখালপাড়ার মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেল (২৪), মুগদার আসাদুজ্জামান ওরফে রানা (২৭) ও উত্তর বাড্ডার আল আমিন (২৬)।
এর কয়েক ঘণ্টা পর রাত দুইটার দিকে শাহীনবাগের বাসা থেকে একই বাহিনী তুলে নিয় যায় এএম আদনান চৌধুরী (২৮) নামের আরেকজনকে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পরিবার জানিয়েছে, আদনানকে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরনের কালো পোশাকের ওপর ‘র্যাব’ লেখা ছিল।
যদিও বসুন্ধরা থেকে উঠিয়ে নেওয়া ছয়জনের বিষয়ে সেই সময় গণমাধ্যমকে কিসমত হায়াৎ বলেছিলেন যে, র্যাব-১-এর কেউ এতে জড়িত নয়।
পরে অবশ্য সাজেদুল ইসলাম সুমনের বৃদ্ধা মা হাজেরা বেগমের কাছে সুমনকে তুলে আনার কথা স্বীকার করেছিলেন কর্নেল জিয়াউল আহসান। একই রাতে রাজধানী থেকে গুম হন বিএনপি কর্মী কাওসার আহমেদ।
গুম হওয়া অন্যদের পরিচয়:
কিসমত হায়াৎ বাহিনীর হাতে গুম হওয়া জাহিদুল করিম ওরফে তানভীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নিজেদের নির্মাণাধীন ভবনের কাজ দেখাশোনা করছিলেন।
আবদুল কাদের ভূঁইয়া ওরফে মাসুম ছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের সম্মান শেষ বর্ষের ছাত্র।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেল। তিনি ৩৪তম বিসিএসে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আইন বিষয়েও পড়াশোনা করছিলেন গুম হওয়া এই তরুণ।
আসাদুজ্জামান ওরফে রানা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকুরি খুঁজছিলেন।
আল আমিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সম্মান শেষ করার পর অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছিলেন।
আর গুম হওয়া আদনান উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
নিখোঁজ আদনানের বাবা রুহুল আমিন তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন যে, ৪ঠা ডিসেম্বর রাত দুইটার দিকে শাহীনবাগের বাসার মূল ফটকে কয়েকজন জোরে জোরে আঘাত করেন। তিনি দরজা খুলে দেন। দেখতে পান যে ১৪-১৫ জন কালো পোশাকধারী লোক অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। তাদের সাথে একটি সাদা ও একটি ছাই রঙের মাইক্রোবাস দাঁড়ানো। তারা প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে জোর করে বাসার ভেতরে ঢোকে এবং আদনানকে খুঁজতে থাকেন। আদনান তার কক্ষ থেকে বের হলে তারা তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়।
আদনান গুম হওয়ার পর রুহুল আমিন গণমাধ্যমকে আরো বলেছিলেন যে, কালো পোশাকধারীরা সবাই হাফ হাতা জ্যাকেট পরা ছিল। কোমর বরাবর জ্যাকেটে হলুদ রঙে ‘র্যাব’ লেখা ছিল।
কিসমত হায়াৎ বাহিনীর হাতে বিএনপির এই আট তরুণ ছাড়াও অনেক নিরপরাধ মানুষ গুম হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যাও করা হয়েছে অনেককে। কিন্তু, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখার পুরস্কার হিসেবে প্রমোশনও জুটেছে তার ভাগ্যে। এমনকি র্যাবে দায়িত্ব পালন শেষ তিনি ফিরেও গেছে নিজ বাহিনীতে।
কিন্তু, তার হাতে গুম হওয়ারা আজও ফেরেনি নিজ বাসায়। এখনও তাদের অপেক্ষায় রয়েছেন বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও সন্তানেরা। নিখোঁজদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা হয়তো কোনোদিনই আর জানা যাবে না।
র্যাব ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করা এই মানুষদের পরিবার আজো অপেক্ষায়। আপনজনরা পথ চেয়ে আছেন, ফিরবেন তারা। কিন্তু তাদের কোন হদিস নেই কোথাও।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে রেখে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে তখন দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন চলছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে উত্তাল সারা দেশ। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল, আন্দোলনের তীব্রতাও বাড়ছিল তখন। পুরো দেশ অচল বলা চলে। এর মাঝেই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করেছে। বাকী ১৪৬ আসনে ভোটের আয়োজন চুড়ান্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার। ১৬৪ আসনে প্রহসনের আয়োজন করা হয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে।
নির্বাচন আওয়ামী ফ্যাসিবাদী প্রহসন ও তামাশা সম্পন্ন করতে নির্লজ্জভাবে সহায়তা করে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী। সারাদেশে তখন শুরু হয় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমন, নির্যাতন ও নিপীড়ন। খোদ রাজধানী ঢাকাতে বিরোধী জোটের ওপর নেমে আসে নিষ্পেষণ। বিএনপি’র মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব থেকে শুরু করে সিনিয়র নেতারা অনেকেই আটক হয়ে কারাগারে। হামলা-মামলা দিয়ে দমন করার অপচেষ্টা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের।