Image description
আস্থা সংকটে আতঙ্কে পুলিশ
পুলিশ বাহিনীতে এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি। কবে ফিরবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা কিছু বলতে পারছেন না। মাঠপর্যায়ের অধিকাংশ পুলিশ সদস্যই আতঙ্কগ্রস্ত। তাদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা। বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে অধস্তন পুলিশ সদস্যদের দূরত্ব এখনো কমেনি। অধস্তনদের অভিযোগ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ পালনের মাধ্যমে মাঠপুলিশকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে জনগণের মুখোমুখি। আন্দোলনকালে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠপুলিশকে ফেলে আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা যারপরনাই ক্ষুব্ধ। ১১টি দাবি আদায়ে অধস্তন পুলিশ সদস্যরা কর্মবিরতি শুরু করায় দেশের ৫৩৮টি থানার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে সীমিত আকারে। সেনাবাহিনীর পাহারায় চালু হওয়া থানাগুলোতে ২/৪টি করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নেওয়া হলেও এখনো শুরু হয়নি অপারেশনালসহ অন্যান্য কার্যক্রম। এদিকে থানার কার্যক্রম চালু করায় কোনো কোনো ওসিকে টেলিফোনে হুমকি দিচ্ছেন কর্মবিরতিতে থাকা ক্ষুব্ধ পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ সুপারদেরও গালিগালাজ করা হচ্ছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসসহ দেশের বিভিন্ন ইউনিটের পুলিশ লাইনসে থাকা পুলিশ সদস্যদের অসন্তোষ রয়েই গেছে। সব মিলিয়ে পুলিশ বাহিনীতে ফেরেনি শৃঙ্খলা। Pause Unmute Remaining Time -10:09 Close PlayerUnibots.com এদিকে থানার কার্যক্রম গতিশীল করতে পুলিশের সহযোগিতায় গতকাল নাগরিক কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল শনিবার বলেছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে আমার প্রথম কাজ হবে পুলিশ সদস্যদের দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পুলিশ সদস্যদের মাঠে রাখা। মানুষের জানমাল রক্ষায় পুলিশ সদস্যদের দায়িত্বে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের রাস্তায় থাকতে হবে। আইজিপির সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস থেকে রবিবার মাঠে নামবে। এই উপদেষ্টা আরও বলেন, পুলিশ বাহিনীকে এতদিন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বাহিনীকে কোনো রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিও যেন ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করতে না পারেন, সে ধরনের আইন ও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস হারানো পুলিশ সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে অন্যায় আদেশ মানতে বাধ্য করা এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে মাঠপুলিশকে রেখে কর্মকর্তাদের পালিয়ে যাওয়ায় ভীষণ ক্ষুব্ধ ও হতাশ। বিভিন্ন ফোরামে তারা পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অন্যায় আদেশ মানতে বাধ্য করার অভিযোগ তুলে ধরছেন। অধস্তন সদস্যরা নিহত পুলিশ সদস্যদের হত্যার বিচার এবং তাদের পরিবারকে সহায়তাসহ ১১টি দাবি তুলেছেন। পরিবার-স্বজন ও বন্ধুদের মধ্যে মুখ দেখাতে পারছেন না বলে অনেক পুলিশ সদস্য মন্তব্য করছেন। কোথাও গেলে আঙুল দিয়ে দেখানো হচ্ছে, ‘ওই যে পুলিশ যায়।’ সেই সঙ্গে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও রয়েছে। পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) বলেন, বাহিনী হিসেবে যে আমি পরিচয় দেব পুলিশ, এই পরিচয় দিতে ভয় লাগে। একটি বাহিনীর ফোর্স হয়ে নিজের পরিচয় দেব, লজ্জা লাগে। পুলিশকে ব্যবহার করে গত যে নির্বাচন হয়েছে, সেই নির্বাচনে গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলার কোনো ভিত্তি নেই। সাধারণ জনগণ কেউ বিএনপি করে, জামায়াত সমর্থন করে তারা অপরাধ না করলেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফলে আমাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আমাদের নির্দেশনা দিয়েছে এলাকায় কোনো বিএনপি-জামায়াত থাকতে পারবে না। মানুষ তো জানে না যে, এটা এসপি স্যার কিংবা ডিআইজি স্যারের নির্দেশ ছিল। মানুষ আমাদের চিনেছে। তিনি আরও বলেন, বাহিনীর রাজনীতিকরণের মধ্যে আমরা আর থাকতে চাই না। শিক্ষার্থী হত্যার বিচার হোক আমরা চাই। কিন্তু যারা মানুষের সামনে আমাদের শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তারা কেন আমাদের রেখে পালিয়ে গেল? আমরা চাই, সারা বাংলাদেশে যেভাবে সংস্কার হচ্ছে, সেভাবে পুলিশেও সংস্কার হবে। জনগণ ও রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করবে পুলিশ। এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, গতকাল শনিবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত সারাদেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৩৮টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন মেট্রোপলিটনের ১১০টি থানার মধ্যে ৮৪টি এবং জেলার ৫২৯টি থানার মধ্যে ৪৫৪টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে কয়েকটি থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেকটা সীমিত আকারেই এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অধিকাংশ থানায় পুলিশ ডিউটি করছে ইউনিফর্ম ছাড়া, সাদা পোশাকে। তাদের বেশিরভাগই আবার হাজিরা দিয়ে চলে যান। থানার নিয়মিত মামলা রুজুসহ অন্যান্য কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি। গতকাল শনিবার দুপুরে হাতিরঝিল থানায় প্রবেশের প্রধান গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন চারজন সেনা সদস্য। থানার ভেতরে প্রহরায় ছিলেন দুইজন আনসার ও দুইজন সেনাসদস্য। থানার ভেতরে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে সাদা পোশাকে বসে থাকতে দেখা যায়। জানা যায়, গত শুক্রবার থানায় দুটি জিডি ও একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে শনিবার কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি। জানা গেছে, বগুড়া জেলায় ১২টি থানা রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি থানার তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ১১টি থানায় পুলিশ অবস্থান করেছে। তারা পুলিশ লাইন্সে ১১ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলনেও যোগ দিয়েছেন। তবে বগুড়া সদর থানা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বগুড়া জেলা পুলিশের কার্যালয়ে সদর থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এদিকে পুলিশের ১১ দফা দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তারা কাজে যোগ দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। থানায় যারা ইউনিফর্ম পরে কাজ করেছে এবং ডিউটি দেওয়া হয়েছে তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। থানার কার্যক্রম চালু করার অভিযোগে ওসিকে দেওয়া হয়েছে মেরে ফেলার হুমকি এবং পুলিশ সুপারকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করা হয়েছে। আমাদের সময়ের হাতে আসা একটি ভিডিও কথোপকথনে দেখা যায়, সিলেট জেলার একটি থানার ওসিকে ফোন করা হয়। ফোনে জানতে চাওয়া হয় আপনি কী আজকে কাউকে ডিউটি শুনিয়েছেন কিনা। ওসি বলেন, ডিউটি শোনাইনি এবং থানায় কাউকে আসতে বলা হয়নি। এরপর ফোনের অপর প্রান্ত থেকে অকথ্য গালিগালাজ করে বলা হয়, ‘যদি শুনছি ডিউটি শোনানো হয়েছে, একবারে ক্রসফায়ার করে দেব।’ ওসি বলেন, আমি আপনাদের কর্মবিরতির সঙ্গে একমত। আমি কাউকে ডিউটি শোনাব না। কিন্তু ওসির কথা মানতে নারাজ ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তি। তিনি বলেন, যদি শুনি ডিউটি শুনাইছোস, ‘তাহলে আগে তোর লাশ পড়বে, পরবর্তীতে অন্য কারো। আইজি স্যারকে পুলিশ লাইনস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আর তুই কে? পোশাক (ইউনিফর্ম) পরলি কেন, সেই ছবি দিলি কীভাবে?’ অপর একটি অডিওতে শোনা যায়, একটি জেলার পুলিশ সুপারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে মোবাইল ফোনে। বলা হয়, থানায় এতগুলো লোক মারা গেছে তুই তার লাশের ওপর দিয়ে ক্যামনে থানার কার্যক্রম শুরু করছোস? থানায় কার্যক্রম শুরুর ব্যানার লাগিয়েছিস কেন? যখন ৫/৬ তারিখে থানা পুড়াইছিল তখন কোথায় ছিলি? এতগুলো পুলিশ মারা গেল তখন কোথায় ছিলি? এরপর একপ্রান্তে বলতে শোনা যায়, আমি কোথায় ছিলাম সেটা সবাই জানে। অন্যপ্রান্তে বলা হয়, এতগুলো লাশের ওপর দিয়ে ব্যানার চলবে না। এক্ষুনি ব্যানার নামা। না হলে অবস্থা খারাপ হবে। এদিকে থানার কার্যক্রম পুনরুদ্ধার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিটি থানা এলাকায় নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনের জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স হতে জেলা পুলিশ সুপার ও থানার অফিসার-ইনচার্জকে (ওসি) নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে গতকাল। পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, কমিটির প্রধান লক্ষ্য হবে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো। এ লক্ষ্যে কমিটি একটি অ্যাকশন প্ল্যান প্রস্তুতপূর্বক মনিটরিং ও মূল্যায়নের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। কমিটির আওতাধীন এলাকার আইনশৃঙ্খলা পুনস্থাপনের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও কমিটির সদস্যদের সমন্বয়ে যৌথ টহল প্রদানের মাধ্যমে হানাহানি, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এলাকায় বিদ্যমান সামাজিক সংঘাত যথা বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি নিরসনে নিবিড় ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেবে। স্থানীয় জনসাধারণের জীবন, সম্পদ, স্থাপনা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয়সহ এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা নিয়মিত তদারকি করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এলাকার মাদক, ইভটিজিং ইত্যাদি সমস্যা নিরসনে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ছাড়া, স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক দলসমূহ ও দল-উপদলের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা নিরসন ও সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। কমিটির কাজের পরিধির বিষয়ে সদর দপ্তর জানায়, পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা বিঘ্নকারীদের বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলা; কেউ যেন কোনো প্রকারের উসকানি দিয়ে পরিবেশ ঘোলাটে করতে না পারে সেজন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করবে কমিটি। পুলিশ সদস্যদের আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানসহ অন্যান্য কার্যক্রমও গ্রহণ করবে কমিটি।