Image description
সোশ্যাল মিডিয়া কি না থাকাই ভালো?
আমীন আল রশীদ রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বরে একটি কলোনির মতো এলাকায় থাকেন জাহিদুল ইসলাম। পাশাপাশি ও মুখোমুখি অনেকগুলো বহুতল ভবন। কয়েকশো পরিবারের বসবাস। মাঝখানে বিরাট খেলার মাঠ। মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয় তার সঙ্গে। বাইরে তখন কারফিউ চললেও জাহিদুল ইসলাম জানালেন, এই কলোনির মাঠ ও তার চারপাশের রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি দেখে তা বোঝার উপায় নেই। অথচ কিছুদিন আগেও এই মাঠে কিংবা রাস্তায় একসঙ্গে এত মানুষের উপস্থিতি ছিল না। বিকালের দিকে কিছু শিশু-কিশোর মাঠে খেলতো। এমনকি পাশের বাসায় কে থাকেন, সেই খবরও অনেকে রাখতেন না। জাহিদুল ইসলামের ধারণা, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার পরবর্তী দুই তিনদিনের মধ্যে এই কলোনির অধিকাংশ মানুষ পরস্পরের সঙ্গে পরিচিতি হয়েছেন। কেননা তারা সবাই ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। এতদিন যারা ইন্টারনেটের সুবিধা নিয়ে অবসরেও ঘরের বাইরে বের না হয়ে বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকতেন— তারাও বাইরে এসেছেন। কেননা ইন্টারনেট না থাকায় সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর বিনোদনে অভ্যস্ত মানুষ অস্থির হয়ে উঠেছেন। যে অস্থিরতা তাদেরকে ঘরের বাইরে বের করে এনেছে এবং ইন্টারনেট-পূর্ববর্তী যুগের মতো পারস্পরিক যোগাযোগ শক্তিশালী করেছে। টেলিভিশনের খবরেও দেখানো হয়েছে, বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাটে কিশোর-তরুণরা ক্রিকেট খেলছে। এমনকি কারফিউয়ের ভেতরেও ভয়ডর উপেক্ষা করে অনেকে রাস্তায় নেমে গেছে। কেননা অনেক জায়গায় শোনা গেছে যে ডিশ লাইন না থাকায় টেলিভিশনও দেখা যাচ্ছে না। ফলে কোনোভাবেই মানুষ ঘরে থাকার উসিলা পাচ্ছিলো না। প্রশ্ন হলো, তাহলে কি ইন্টারনেট না থাকাই ভালো? একটু পেছনে ফেরা যাক। সিলেটের শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যার মামলার বিচারকাজ শেষ হয়েছিল মাত্র ১৭ কার্যদিবসে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। দেশের আদালতগুলোয় যেখানে প্রায় ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন, সেখানে মাত্র ১৭ দিনে এরকম একটি চাঞ্চল্যকর মামলার বিচারকাজ শেষ করা সম্ভব হয়েছে সামাজিক চাপের কারণে। আর এই চাপটি এসেছে ফেসবুকের মাধ্যমে। কেননা রাজনকে পিটিয়ে হত্যার বিভৎস দৃশ্যটি মোবাইল ফোনে ধারণ করা হয়— যা আদালতে অপরাধ প্রমাণকে সহজ করেছে। তাছাড়া নৃশংস ওই ঘটনার বিচার দাবিতে সারা দেশে একটি জনমতও গড়ে ওঠে। সিলেটে খাদিজা নামে এক কলেজছাত্রীর ওপর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের হত্যার নৃশংস দৃশ্য আমরা টেলিভিশনে দেখেছি প্রধান খবর হিসেবে, যে ছবিটি ধারণ করেছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী তার মোবাইল ফোনে এবং সেই ছবি ভাইরাল হয় ফেসবুকে। এরপর তোলপাড়। নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানোর দৃশ্য ফেসবুকে প্রকাশ হবার পরে তোলপাড় শুরু হয় সারা দেশে। এরপর সরকারের ওপর যে মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়, তার ফলে শ্যামল কান্তির বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাকে স্বপদে পুনর্বহাল করা হয়। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করানোর এই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং এরপরে মূলধারার গণমাধ্যমে প্রচারিত না হলে শ্যামল কান্তির ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হতো। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণজমায়েত গণজাগরণ মঞ্চও গড়ে উঠেছি। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে। সাম্প্রতিক প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম ও ‍দুর্নীতির নানা খবর গণমাধ্যমে এলেও তার একটা বড় উৎস মূলত সোশ্যাল মিডিয়া। এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমানের বিশাল সম্পদের খোঁজ মিলেছে তার ছেলের ১৫ লাখ টাকার ছাগল ইস্যুতে। বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পরেই এ নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান শুরু হয় এবং এরপর একে একে বেরিয়ে আসে মতিউরের সম্পদের পাহাড়। অন্য আরও একাধিক ঘটনার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে সোশ্যাল মিডিয়া। প্রশ্ন উঠতে পারে, যখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, তখন কি দুর্নীতির খবর জানা যেত না? যেতো। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে কাজটা এখন সহজ হয়েছে। এর প্রধান কারণ, মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন এবং তাতে ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকায় কোনও কিছুই গোপন থাকে না। প্রতিটি ঘটনাই কারো না কারো মোবাইল ফোনে ধরা পড়ে। আবার অনেকে ‘ইনোসেন্টলিও’ অনেক ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে বড় কোনও বিষয়ের জন্ম দিতে পারেন। অনেক ফেসবুক পোস্ট কিংবা ছবি অথবা ভিডিও বড় কোনও খবরের সূত্র হতে পারে। এর বিপরীত চিত্রও আছে। গণমাধ্যম চাইলেই যেকোনও কিছু প্রকাশ বা প্রচার করতে পারে না তার একটি সম্পাদকীয় নীতি এবং সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ রয়েছেন— যারা কোনও একটি সংবাদ বা বিশ্লেষণ একটি ছবি প্রকাশের আগেও নানাভাবে সেটি পরীক্ষা করে দেখেন যে কোথাও কোনও ত্রুটি আছে কিনা। অর্থাৎ তার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে ওই সংবাদ ও ছবিটা সাংঘর্ষিক কিনা। সুতরাং একজন রিপোর্টার কিছু একটা লিখলেই সেটি পত্রিকা বা টেলিভিশনে প্রকাশিত হয়ে যাবে—বিষয়টা এমন নয়। কেননা সংবাদটি প্রকাশ বা প্রচারের আগে এক বা একাধিক গেট পার হতে হয়। যে গেটে এক বা একাধিক পাহারাদার (সম্পাদক) রয়েছেন। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই সুযোগ নেই। কেননা এখানে কোনও গেট কিংবা গেটকিপার নেই। যা খুশি লিখে আপ করে দেওয়া যায়। তাতে আইনি জটিলতায় পড়ার শঙ্কাও থাকে। আবার অনেকে সচেতনভাবেই নানারকম ভুল, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর কথা কিংবা এডিটেড ছবি অথবা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে সমাজে অস্থিরতার জন্ম দিতে পারেন। অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাওয়া অর্ধসত্য, ভুল বা অপতথ্য মূলধারার গণমাধ্যমকেও বিভ্রান্ত করে। পেশাদারি ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন আছে— এমন অনেক অনলাইন পোর্টাল এমনকি সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেলও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যাওয়া গুজবে ভর করে সংবাদ প্রকাশ করেছে, এরকম উদাহরণও ভুরি ভুরি। যারা ঘটনা বা ফ্যাক্ট ক্রসচেক না করেই সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও কিছু শেয়ার করেন কিংবা অর্ধসত্য অথবা বিভ্রান্তিকর কোনও বিষয় দেখেই উত্তেজিত হয়ে যান, তার পেছনে রয়েছে ডিজিটাল লিটারেসির ঘাটতি। বাংলাদেশের মানুষের হাতে হাতে ‍যত দ্রুত স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটে কল্যাণে সোশ্যাল মিডিয়া পৌঁছে গেছে, এগুলো ব্যবহারের শিক্ষা বা এটিকেট তত দ্রুত পৌঁছেনি। অনেক শিক্ষিত মানুষও ফেসবুককে সংবাদমাধ্যম মনে করেন। যেমন রাস্তায় চলতে গিয়ে প্রায়শই কানে আসে যে, একজন আরেকজনকে বলছেন: ‘দেখেন তো নিউজটা ফেসবুকে দিছে কি না?’ অথচ ফেসবুক বা এরকম সোশ্যাল মিডিয়া যে সংবাদমাধ্যম নয়, সেই বোধের ঘাটতি অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া কবে চালু হবে? দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কয়েকদিন বন্ধ থাকার পরে সীমিত আকারে ইন্টারনেট পুনরায় চালু হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া চালু হয়নি। কবে হবে সে বিষয়ে সরকারের তরফে পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি। তবে এটা ঠিক যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইন্টারনেট তথা সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক বেড়েছে। যে তরুণরা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করলেন, তাদের সবাই সরকারি চাকরি পাবেন না। তাদের অধিকাংশকেই বিভিন্ন বেসরকারি চাকরি করতে হবে। তাদের অনেকে হয়তো উদ্যোক্তা হবেন। অনেকে হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর নানাবিধ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হবেন। পক্ষান্তরে এটিও ঠিক যে, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেই নানারকম গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। সেটিও সরকারের জন্য বিরাট উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু তারপরও অনির্দিষ্টকালের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে রাখলে তাতে দেশের অর্থনীতিও যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেই বাস্তবতাটি সরকারও জানে। কিন্তু তাকে একদিকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা নিয়ে যেমন ভাবতে হয়, তেমনি অর্থনীতি। এমতাবস্থায় নাগরিকদের নাগরিক হয়ে ওঠা তথা ডিভাইস ও ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতন থাকার কোনও বিকল্প নেই। ‘হুজুগে বাঙালি’ না হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্তিপূর্ণ আচরণ করা উচিত। সেটি অবশ্য একদিনে হবে না। বলা হয়: Social media is not only about connection, but about sharing…অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম কেবল এক ধরনের সম্পৃক্ততাই নয়, বরং এর মূল লক্ষ্য আদান-প্রদান। এই আদান-প্রদান চিন্তার, এই আদান-প্রদান ভাবের, দর্শন ও মতের। সমাধান কী? খারাপ লোকদের ‘ভয়ে’ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া কোনও সমাধান নয়। বরং নাগরিকের ডিজিটাল লিটারেসি বাড়াতে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে। সেইসাথে এই মাধ্যমকে কীভাবে আরো বেশি শক্তিশালী করা যায়; সরকার এই মাধ্যম ব্যবহার করে কীভাবে আরো বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে যেতে পারে; কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে সরকার তার স্বচ্ছতা ও জবাবিদিহি নিশ্চিতের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এবং সরকারকে আরও বেশি জনসম্পৃক্ত করতে পারে—সেই ভাবনাটিই বরং জরুরি। লেখক: সাংবাদিক