গত রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনে প্রশাসন ক্যাডারের নবীন কর্মকর্তারা জড়ো হন এবং তারা প্রশাসন ক্যাডারের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন।
এ সময় আয়োজিত এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রশাসন ক্যাডারের নবীন কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং এই সিদ্ধান্ত তাদের প্রতি ‘ভয়াবহ অবিচার’ উল্লেখ করে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবেই উপসচিব পদে মূলত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই কাজ করে থাকেন। এ বিষয়ে করা রিট মামলায় উচ্চ আদালতে আইনি লড়াই শেষে ২০১০ সালের ২৪ মে আপিল বিভাগ চূড়ান্ত আদেশে উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে ৭৫ শতাংশ নিয়োগ প্রদান বৈধ ঘোষণা করেন।
প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তারা মনে করেন, আদালতের রায় উপেক্ষা করে এ ধরনের সুপারিশের প্রস্তাব একদিকে আদালত অবমাননার শামিল, অপরদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করার শামিল। পাশাপাশি এই সুপারিশ নবীন কর্মকর্তাদের জন্য বৈষম্যমূলক। এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে এবং রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা দুর্বল হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
মতবিনিময় সভায় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৩০ ব্যাচ থেকে ৪১ ব্যাচের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরীসহ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সরকারের নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ‘কোর’ অফিসগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজ করেন। এই সুপারিশের ফলে প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রায় ৪০% কমে যাবে। ফলে এক বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তার ক্যারিয়ার অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, যা প্রভাব ফেলবে প্রশাসনের ‘স্পিরিট ডি কর্পস’ বা মনোবলে। প্রশাসন যেহেতু সরকারের নানা নীতি বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, সেহেতু মনোবলহীন প্রশাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার নামান্তর হবে।
নবীন কর্মকর্তারা আরও মনে করে, সরকারের নীতি বাস্তবায়নে তারা প্রায় ২৪/৭ মাঠে কাজ করে থাকে। ৫ আগস্টের পর যখন রাজনীতিবিদেরা মাঠে অনুপস্থিত ছিলেন, পুলিশ অকার্যকর ছিল, তখন স্থানীয় সরকারের নানা পর্যায়ে যেমন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়র ইত্যাদি নানা পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরকারকে কার্যকর রেখেছেন। এই সুপারিশের ফলে ক্যারিয়ারে পদসোপান যদি কমে যায় তবে তারা বাড়তি কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এতে করে মাঠ প্রশাসনের কার্যকারিতা অনেকাংশেই কমে যাবে এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ভেঙে যাবে। ফলে সরকারের নীতি বাস্তবায়নে নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে পড়বে, যার প্রভাবে রাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়নে সক্ষমতা কমে যাবে। এই সময়ে যা হতে পারে সরকারের জন্য বিপজ্জনক।
নবীন কর্মকর্তাদের মধ্যে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, উপসচিব পদটি প্রশাসন ক্যাডারের সহজাত পদ বলে রায় দিয়েছেন আপিল বিভাগ। সেটি উপেক্ষা করে এই অন্যায্য সুপারিশ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য বৈষম্যমূলক। যেখানে অন্য সব ক্যাডার কর্মকর্তারা পঞ্চম গ্রেডে পদোন্নতির দুটি সুযোগ পাচ্ছেন (১. নিজের ক্যাডারের পঞ্চম গ্রেডে পদোন্নতির সুযোগ, ২. উপসচিব পদে পদোন্নতির সুযোগ) সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা পাচ্ছেন একটি উপসচিব পদে পদোন্নতির সুযোগ। তাছাড়া এই সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছেন জুনিয়র কর্মকর্তারা, যারা এখনো উপসচিব পদে পদোন্নতি পাননি। এসব কর্মকর্তারা বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সময় উপসচিব পদে নিজেদের সুযোগ ৭৫% আছে ধরেই চয়েস প্রদান করেছেন। ক্যারিয়ারের মাঝপথে এসে এই ধরনের পরিবর্তন ‘ডকট্রিন অব লেজিটিমেট এক্সপেকটেশন’-এর লঙ্ঘন।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন নেতারা ধৈর্য ধরে নবীন কর্মকর্তাদের কথা শোনেন এবং তাদের বক্তব্য সরকারের উচ্চমহলে তুলে ধরার আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া ও কার্যক্রম গ্রহণের আশ্বাস দেন।