দেশের আকাশপথে যাত্রী পরিবহন বেড়েছে। শিক্ষার্থী, পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ভ্রমণ বেড়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী কিছুটা কমেছে। দেশের বিমান পরিবহনের হাব হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ যাত্রী পরিবহনের কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিত হিমশিম খাচ্ছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। যাত্রীরাও কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে অসন্তোষ জানাচ্ছেন।
কর্তৃপক্ষ বলছে, বছরের শেষ নাগাদ তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে যাত্রী ভোগান্তি কমবে, বাড়বে সেবার মান। তখন বছরে দুই কোটির বেশি যাত্রী নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারবেন। একই সঙ্গে আরো বেশি বিমান সংস্থা ঢাকা থেকে ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সর্বশেষ প্রতিবেদন মতে, ২০২৪ সালে দেশের বিমানবন্দরগুলো দিয়ে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটে রেকর্ড এক কোটি ২৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭০৬ জন যাত্রী যাতায়াত করেছেন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৬ লাখ ৮১ হাজার ১৫০। অর্থাৎ এক বছরে যাত্রী বেড়েছে আট লাখ ছয় হাজার ৫৫৬ জন বা ৬.৯ শতাংশ।
বেবিচকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এদের বেশির ভাগই আন্তর্জাতিক যাত্রী। আন্তর্জাতিক যাত্রীর সংখ্যা গত বছর সাত লাখ ২৯ হাজার ৬৩৯ জন বেড়েছে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে ৭৬ হাজার ৯১৭ জন কমেছে।
বেবিচকের তথ্য মতে, দেশের অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে ২০২৪ সালে যাত্রী কমেছে ৭৬ হাজার ৯১৭ জন। এর ফলে অভ্যন্তরীণ রুটে এক বছরে ফ্লাইট কমেছে আট হাজার ১০৬টি। আর আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রী বাড়ার কারণে এক বছরে ফ্লাইট বেড়েছে এক হাজার ১২৫টি। এ কারণে জেট ফুয়েলের চাহিদা বেড়েছে ৩২ হাজার ৫৯৮ মেট্রিক টন।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৮০ লাখ যাত্রী পরিবহনের উপযোগী করে বিমানবন্দরের বর্তমান টার্মিনালটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ২০২৪ সালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ যাত্রী আমরা সুষ্ঠুভাবে পরিবহন করতে সক্ষম হয়েছি। বাড়তি যাত্রীর চাপের কারণে বিমানবন্দরে যে ২৮টি সংস্থা কাজ করছে, তাদের সবাইকে বাড়তি চাপ সামাল দিতে হচ্ছে। বিমানবন্দরে ৪০টিরও বেশি এয়ারলাইনস এখন ঢাকা থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আমাদের সব স্টেকহোল্ডারের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি আমরা উত্তরণ করছি। বিদ্যমান অবকাঠামোর মধ্যেই কিভাবে আরো ভালো সেবা দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন যথাসময়ে লাগেজ পাচ্ছেন যাত্রীরা। এ ছাড়া প্রবাসী কর্মীদের জন্য প্রবাসী লাউঞ্জসহ, পানি, কম মূল্যে খাবারসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। আমাদের এই পরিবর্তন প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে বিশ্বমানের সেবা পাবেন যাত্রীরা।’
জানতে চাইলে এয়ার অ্যাস্ট্রার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আসিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার সময় প্রায় আড়াই বছর মানুষ বিদেশ ভ্রমণ করেনি। সেই সময়ের জমে থাকা ভ্রমণ করোনা শেষ হওয়ার পর থেকেই বাড়া শুরু করেছে। তবে তা করোনাপূর্ব অবস্থায় পৌঁছায়নি। চাহিদা অনেক বাড়লেও এয়ারলাইনসগুলোর ক্যাপাসিটি এখনো আগের অবস্থায় যায়নি।’
তিনি বলেন, বিমানবন্দরে বাড়তি যাত্রী পরিবহন করতে বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়। সে জন্য যে পরিমাণ অবকাঠামো প্রয়োজন হয় তা আমাদের বিমানবন্দরে নেই। এই সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েও এয়ারলাইনস, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাত্রীসেবা দিচ্ছি। কিন্তু এর চেয়েও ভালো যাত্রীসেবা হওয়া উচিত।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদায়ি বছরের শুরুতে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর মানুষের আকাশপথে চলাচল কমে যায়। অভ্যন্তরীণ গন্তব্যের ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ যাঁরা নিয়মিত যাত্রী ছিলেন, তাঁদের একটি অংশের যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। এটার প্রভাবে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে যাত্রী কমেছে। আন্তর্জাতিক যাত্রী বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি হয়নি। বছরের মাঝে এসে হঠাৎ করে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর ফলে যাত্রীদের ওপর চাপ তৈরি করেছে।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা ৮০ লাখ। কিন্তু যাত্রী পরিবহন হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। এখানে চেক ইন, ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকে শুরু করে অন্যান্য অবকাঠামো দ্বিগুণ নয়। তার পরও আমরা সবাই মিলে চেষ্টা ও ভালো তদারকি করে চেষ্টা করছি আরো ভালো সেবা দিতে। বেশি মানুষকে যাত্রীসেবা দিতে গিয়ে সবাইকে বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এই সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ তৃতীয় টার্মিনাল চালু হবে।’
এদিকে যাত্রী বাড়ায় দেশে উল্লেখযোগ্য হারে জেট ফুয়েলের ব্যবহার বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেট ফুয়েল বিক্রি হয় পাঁচ লাখ ৪১ হাজার ৩৩ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেট ফুয়েল বিক্রি হয়েছে চার লাখ ৭১ হাজার ৫৩৫ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে জেট ফুয়েল বিক্রি হয় চার লাখ ২৮ হাজার ২৪ মেট্রিক টন।
বিপিসির জেট ফুয়েল বিক্রির প্রাক্কলিত চাহিদার তথ্যে দেখা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জেট ফুয়েল বিক্রির প্রাক্কলিত চাহিদা ধরা হয়েছে ছয় লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জেট ফুয়েল বিক্রির প্রাক্কলিত চাহিদা ধরা হয়েছে সাত লাখ ৪৮ হাজার মেট্রিক টন।