প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষমতা কমাতে ও আন্ত ক্যাডার বৈষম্য দূর করতে ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস)’ নামে নতুন একটি সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সরকারের উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা এই সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। এই সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই পূরণ করা হবে প্রশাসনের শীর্ষ পদ মন্ত্রিপরিষদসচিব, মুখ্যসচিবসহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের পদ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের জন্য আলাদা সার্ভিস কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত প্রতিবেদনে বিভাগীয় কমিশনারকে প্রশাসন ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। সমবায় ও খাদ্য ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একত্রকরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া টেকনিক্যাল ক্যাডারগুলোর সমন্বয়ে প্রকৌশল সার্ভিস, কৃষি, বাণিজ্যসহ এ জাতীয় ক্যাডারগুলোর সমন্বয়ে কৃষি সার্ভিস এবং রাজস্ব সার্ভিস, তথ্য সার্ভিস নামে ১১ থেকে ১২টি সার্ভিস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দেশের পুরনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশ করার পাশাপাশি বিদ্যমান আটটি প্রশাসনিক বিভাগের বাইরেও কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে নতুন বিভাগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি আগামীকাল ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হবে বলে কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন কমিশনপ্রধান ড. আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী।
কমিশনের সদস্যসচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী দেশের পুরনো এই চার বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।’ তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি তিনি।
নতুন ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস’ গঠনের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সচিবালয়ের উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদগুলোতে নিয়োগ পাওয়ার প্রত্যাশা বিভিন্ন সার্ভিস কর্মকর্তাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে।
অতীতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন (২০০০) এবং বেতন ও চাকরি কমিশন (১৯৭৭) এবং প্রশাসনিক ও পরিষেবা পুনর্গঠন কমিটি (১৯৭২)-এর উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদগুলো নিয়ে একটি পৃথক সিনিয়র সার্ভিস গঠন করার সুপারিশ করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে কমিশন মনে করে, মন্ত্রণালয়ের উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদগুলো নিয়ে ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস’ গঠিত হতে পারে। সরল সার্ভিস থেকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে এসইএসে নিয়োগ করা হলে মেধার প্রাধান্য নিশ্চিত হবে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মাধ্যমে আন্ত সার্ভিস বৈষম্য দূর হবে। বাস্তবতার নিরিখে প্রশাসনিক সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় বর্তমানে উপসচিব পদের ৭৫ শতাংশ ওই সার্ভিসের জন্য সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা রাখা আছে। আন্ত সার্ভিস বৈষম্য দূর করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কমিশন প্রশাসনিক সার্ভিসের ৭৫ শতাংশ কোটা হ্রাস করে ৫০ শতাংশ করার বিষয়টি অধিকতর যৌক্তিক মনে করছে। অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ পদ অন্যান্য সার্ভিসের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তবে বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলার রায় ও পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টির আইনগত দিক পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিশনের একাধিক সদস্য জানান, ২৬টি ক্যাডারকে সার্বিক বিষয় বিচেনায় নিয়ে ১১ থেকে ১২টি সার্ভিসে ভাগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেসব ক্যাডারের কাজকর্ম এক ধরনের বা বৈশিষ্ট্যের, সেসব ক্যাডারকে এক করে সার্ভিস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ছোট দুটি ক্যাডারকে প্রশাসনিক (প্রশাসন) ক্যাডারের সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান পিএসসি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডার বাদে সব নিয়োগ দেবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সার্ভিস কমিশন এই দুটি সেক্টরের ক্যাডার নন-ক্যাডার সব ধরনের নিয়োগ দেবে। এ ছাড়া দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি বিবেচনা করে চার পুরনো বিভাগকে প্রদেশ এবং কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে নতুন বিভাগ করার কথা বলা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগকে পুনর্গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিশন সূত্র জানায়, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন অংশীজনদের মতামত নেওয়ার পর কয়েক দিন ধরে সিরিজ বৈঠক করে কমিশনের রিপোর্ট চূড়ান্ত করে। গত শনিবার শেরেবাংলানগরে সকাল ১১টা থেকে সাত ঘণ্টার বৈঠকে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে কমিশন। অন্তর্বর্তী সরকার গত সেপ্টেম্বরে কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে। গত ৩১ ডিসেম্বর কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও কাজ অসমাপ্ত থাকায় সরকার কয়েক দফায় সময় বাড়িয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদন চূড়ান্ত হওয়ায় প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ও হাতাশার সৃষ্টি হয়েছে। রবিবার রাতে রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) জরুরি সভা হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিব নজরুল ইসলাম। বৈঠকে সংস্কার কমিশনের কিছু প্রস্তাব নিয়ে নবীন কর্মকর্তাদের মতামত নেওয়া হয়। উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে পরীক্ষা পদ্ধতি ও কোটা ৭৫ থেকে ৫০ শতাংশ হওয়ায় মাঠ প্রশাসন ও সচিবালয়ের নবীন কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ব্যাচের প্রতিনিধিরা তাঁদের উদ্বেগ ও হতাশার কথা জানান।