বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে চুরির ৯ বছর পূর্ণ হয়েছে। চুরির বছরই স্বেচ্ছায় সামান্য অংশ ফেরত পেয়েছিল বাংলাদেশ। বাকি অর্থ ফেরত পেতে ফিলিপিন্স ও যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা চলছে। মামলা পরিচালনায় আইনজীবী ও আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠানের ফি বাবদ মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ হচ্ছে। তবে অর্থ ফেরত বা চলমান মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। সমঝোতার মাধ্যমে অর্থ ফেরতের প্রস্তাবেও সাড়া নেই ফিলিপিন্সের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ফিলিপিন্স থেকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অর্থ ফেরত না পেয়ে ছয় বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সমঝোতায় অর্থ আদায়ের একটি রায় দেন দেশটির আদালত। সমঝোতার জন্য ২০২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি ফিলিপিন্সে যায় বাংলাদেশের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। সেখানে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়। তারা দেশটিতে চলমান বিভিন্ন মামলায় তিনটি আদালতে সাক্ষ্য দেয়। তবে সমঝোতায় সাড়া মেলেনি। আবার ফিলিপিন্সের আদালত থেকে কোনো রায় হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতেও কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে আদৌ অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে, নাকি মামলা পরিচালনায় বছরের পর বছর শুধু অর্থ খরচ করতে হবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। শ্রীলঙ্কায় নেওয়া দুই কোটি ডলার ওই সময় ফেরত পায় বাংলাদেশ।
মামলার বিষয়ে বাংলাদেশের আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠান কোজেন ও’কনর বিবাদীদের নোটিশ দেয়। এরপর আরসিবিসি, অভিযুক্ত ব্যক্তি লরেঞ্জ ভি টান, রাউল টান, সোলায়ের ক্যাসিনো, ইস্টার্ন হাওয়ায়ে এবং কিম অং যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ‘মোশন টু ডিসমিস’ বা মামলাটি না চালানোর অনুরোধ জানিয়ে আবেদন করেন। তাঁদের আবেদনের বিষয়ে ২০২১ সালের ১৪ জুলাই ও ১৪ অক্টোবর শুনানি হয়। ২০২২ সালের ৮ এপ্রিল আংশিক রায় হয়। ২০২৩ সালের ১৩ জানুয়ারি ছয় বিবাদীর ‘মোশন টু ডিসমিস’ বা মামলা না চালানোর আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আরসিবিসিসহ অন্য বিবাদীদের মধ্যস্থতার নির্দেশ দেন স্টেট কোর্ট। তবে সমঝোতায় সাড়া দেয়নি ফিলিপিন্স। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতেও পরে কোনো শুনানি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে অর্থ ফেরত পাওয়া অনেক জটিল। যে কারণে শুরু থেকেই সমঝোতার মাধ্যমে চেষ্টা ছিল। তবে তাতে ফিলিপিন্সের দিক থেকে সাড়া মিলছে না। আবার যুক্তরাষ্ট্রের আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়া অনেক সময়সাপেক্ষ। ফলে বাংলাদেশের অর্থ ফেরত পাওয়ায় অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর বা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক কৌশল নির্ধারণে সরকার গঠিত টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সাইবার হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৬৭৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা চুরি করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত রিজার্ভ চুরির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। রিজার্ভ চুরির ঘটনার সময় গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন আতিউর রহমান।
অন্যদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তদন্তপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার কথাও বলা হয়েছে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন ৮০ বার পেছানো হয়।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে টাকাটা চলে গেছে সেটা আসলে ডাকাতি হয়েছে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিকিউরিটি সিস্টেমকে হ্যাক করে টাকাটা পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়া প্রথম দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে লুকিয়ে রেখেছিল। প্রাথমিক সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাই ওই সুযোগটা আমরা হারিয়েছি। সে কারণে এখন প্রক্রিয়াটা আরো দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকাটা চুরি হয়, তখনকার গভর্নর ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এর দায় আড়াতে পারেন না। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি।’
১১ জানুয়ারি রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া অর্থের ৮০ শতাংশ ফেরত আনা হয়েছে। কিন্তু কোন দেশ থেকে ফেরত এসেছে বা তার পরিমাণই বা কত সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মামলা চলমান থাকায় এখন আমরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।’