সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে সেখানকার শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের পঞ্চম দিনে সড়কের পাশাপাশি রেলপথও অবরোধ করা হয়। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হন হাজারো মানুষ।
সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রথমে মহাখালী–গুলশান লিংক রোড (বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়ক) অবরোধ করেন। বিকেল পৌনে চারটার দিকে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মহাখালীতে রেললাইনে অবস্থান নিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেন। এর ফলে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
সর্বশেষ রাত ১০টার দিকে কলেজের শিক্ষার্থীরা আগামী সাত দিনের জন্য আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন এবং রেললাইন থেকে অবরোধ তুলে নেন। এর আগে বিকেল পৌনে ৪টা থেকে রাত সোয়া ১০টা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা কোনো ট্রেন রাজধানীর কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যেতে পারেনি। মহাখালীতে অবরোধের কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমলাপুর স্টেশনে আটকে পড়েন হাজারো ট্রেনযাত্রী। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে থেকেও কোনো ট্রেন কমলাপুর পর্যন্ত আসতে পারেনি।
সড়ক অবরোধের সময় মহাখালী এলাকায় রোগী বহনকারী গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেননি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। যে কারণে ভারী ব্যাগ হাতে বা শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে মহাখালী-গুলশান লিংক রোড পার হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। প্রবীণ ব্যক্তিদেরও কষ্ট করে হেঁটে যেতে হয়েছে। নিরুপায় অবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
দুপুরে তিতুমীর কলেজের সামনের সড়ক পার হচ্ছিলেন রজ্জব আলী-রাশেদা বেগম দম্পতি। তাঁরা ঢাকার ধামরাই থেকে সকালে এসেছিলেন মহাখালীর একটি হাসপাতালে। ফেরার পথে সড়ক অবরোধের মধ্যে পড়েন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রজ্জব আলী বলেন, ‘তাদের (শিক্ষার্থীদের) তো মানুষের কষ্ট বোঝা উচিত।’
রজ্জব আলীর মতোই ভোগান্তিতে পড়েন জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর বাড়ি যশোরের কেশবপুরে। বোন আকলিমা আক্তারের চিকিৎসার জন্য কয়েক দিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন। বোনকে ভর্তি করান মহাখালীর একটি হাসপাতালে। চিকিৎসা শেষে দুপুরে হাসপাতাল থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন তাঁরা। জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা রাস্তা আটকে রেখেছেন। কোনো বাস চলছে না। পরে হেঁটেই রওনা হয়েছি। বোনের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কী করা!’
এর আগে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে জানিয়ে লায়েক নুর মোহাম্মদ বলেন, এ কমিটি ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কার্যক্রম ও কলেজ পরিচালনা করবে। আমরা কি এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সবাই একমত- প্রশ্ন করে সবার মতামত চান তিনি। পরে শিক্ষার্থীরা ‘হ্যাঁ’ বলে সাড়া দেন। এরপর অনশনরত শিক্ষার্থীদের জুস খাইয়ে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়।
সোমবার বেলা ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ‘বারাসাত ব্যারিকেড টু ঢাকা নর্থ সিটি’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এ কর্মসূচির আওতায় মহাখালী, আমতলী, রেলগেট ও গুলশান লিংক রোড অবরোধ করা হয়। তবে এদিনের কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আগের চার দিনের তুলনায় কিছুটা কম ছিল। দুপুরে সড়ক অবরোধের পর বেলা সোয়া তিনটার দিকে শিক্ষার্থীরা কলেজের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে মহাখালীর আমতলী মোড়ের দিকে রওনা হন। এ সময় অনশনকারী তিন শিক্ষার্থীকেও হুইলচেয়ারে করে মিছিলের সঙ্গে আনা হয়। আমতলী মোড়ে পৌঁছানোর পর মিছিলটি সেখানে না থেমে মহাখালী রেলক্রসিংয়ের দিকে এগিয়ে যায়। পৌনে চারটার দিকে মহাখালী রেলক্রসিং এলাকায় পৌঁছে শিক্ষার্থীরা রেললাইনে বসে পড়েন।
শিক্ষার্থীরা যখন রেললাইনে অবস্থান নিচ্ছিলেন, তখন কমলাপুর থেকে নোয়াখালীগামী উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি মহাখালীর দিকে আসছিল। ট্রেনটিকে লাল নিশানা দেখিয়ে থামানো হয়। কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ওই ট্রেন পেছনের দিকে চলে যায়।
রেললাইন অবরোধের এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি মহাখালী রেলক্রসিং এলাকায় আসেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। তখন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রেললাইনের ওপর বসে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবিতে নানা স্লোগান দিচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের চারপাশ থেকে ঘিরে রাখেন। রেললাইনের পাশে পুলিশের একটি জলকামানও এনে রাখা হয়।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মহাখালীতে আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীদের একজন আলী আহাম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যতক্ষণ না আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হবে এবং তিতুমীরকে বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা না দেওয়া হবে, ততক্ষণ আমরা রেললাইন ছাড়ব না।’
আলী আহাম্মেদ বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রতিনিধিদল সন্ধ্যায় (গতকাল) কলেজে গেছে। আলোচনার জন্য আমাদের ক্যাম্পাসে যেতে বলেছে তারা। কিন্তু এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে প্রতিনিধিদলকে মহাখালীতে আসার কথা বলেছি আমরা।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা।