২০শে জুলাই। দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর সোয়া ১২টা। ইমাম হাসান তাইম বন্ধুদের সঙ্গে কাজলা ফুটওভার ব্রিজের পাশে লিটন স্টোরে চা খেতে গিয়েছিলেন। ওখানে কোটা আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করছিল। হঠাৎ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে পুলিশ। প্রাণ ভয়ে আন্দোলনকারীরা এলোপাতাড়ি ছোটাছুটি করতে থাকে। তাইম ও তার দুই বন্ধু চা স্টোরের সাটার টেনে দেয়। কিন্তু সাটারের নিচের দিকে আধা হাত খোলা ছিল। দোকানে অবস্থানকারীদের দেখতে পেয়ে কয়েকজন পুলিশ এসে চায়ের দোকান থেকে তাদের ৩ জনকে টেনে বের করে প্রথমে মারধর করেন। এরপর গুলি থেকে বাঁচতে চাইলে দৌড় দিতে বলে পুলিশ। তাইম প্রাণভয়ে দৌড় দিলে, তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে পুলিশ।
প্রায় ৩০ মিনিট বিনা চিকিৎসায় রাস্তায় পড়ে ছিল সে। গুলিবিদ্ধ তাইমকে ভ্যানে যাত্রাবাড়ী থানায় নিয়ে যাওয়ার পরে নির্যাতন করে মুখ বিকৃত করে তার হত্যা নিশ্চিত করা হয়। এরপর লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ফেলে আসে। তাইমের সুরতহাল প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ডান হাতের কনুইয়ের নিচে কব্জি পর্যন্ত চারটি ছিদ্র...মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্রায় ১০০টি কালো ছিদ্র ও জখম।
জুলাই-আগস্টের বিপ্লবে সবচেয়ে বড় গণহত্যা হয়েছিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়। আহত অবস্থায় পড়ে থাকার পরেও ব্রাশফায়ার করে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। প্রায় চার শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয় যাত্রাবাড়ী এলাকায়। সেই হত্যাকাণ্ডে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান। তার সঙ্গে বেশ কিছু অফিসার জড়িত ছিলেন-এর মধ্যে ওসি তদন্ত জাকিরও একজন।
তাইমের মা পারভীন আক্তারের করা মামলায় কয়েকজন আসামির বিরুদ্ধে আগেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। অভিযুক্ত সাবেক ওসি আবুল হাসান ও এসি তানজিল আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরিবারের দাবি, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে, আসামিদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিলেও তাদের গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।
পরিবারের অভিযোগ, ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে তাইমের মা পারভীন আক্তার গত ২০শে আগস্ট ঢাকার সি এম এম কোর্টে মামলা করে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করার জন্য আসামিদের সন্ধান দিয়ে পুলিশের সাবেক আইজিপি ময়নুল ইসলাম এবং ৪ঠা সেপ্টেম্বর ডিএমপি কমিশনার মাঈনুল হাসান ও ৮ই সেপ্টেম্বর ডিবি প্রধান রেজাউল করিম মল্লিকের লিখিত অভিযোগ দিলেও আসামিদের গ্রেপ্তার না করে স্বজনপ্রীতি করে পুলিশ।
পরবর্তীতে, গত ২২শে অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করলে, বিজ্ঞ আদালত ১২ই নভেম্বর ৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ওইদিনই আসামিদের সন্ধান দিয়ে ডিআইজি অপারেশন রেজা গ্রেপ্তারের জন্য অনুরোধ জানালেও তিনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নাই। এ ছাড়াও আসামিদের সঙ্গে গত ১৪ই নভেম্বর ফোনে কয়েক সেকেন্ড কথা বলে সঙ্গে সঙ্গে ডিআইজি রেজাকে অবগত করলেও আসামিদের ডেজিগনেশন জেনে আচ্ছা দেখতেছি বলে ফোন রেখে দেন।
এ ছাড়াও কয়েকজন আসামি গত ২১শে নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশেই চাকরিরত ছিল, কিন্তু তাদের গ্রেপ্তার না করায় তারা এখন পলাতক বলে জানায় তাইমের পরিবার।
সন্ধানকৃত আসামিদের গ্রেপ্তার না করে স্বজনপ্রীতি দেখানোর কারণে গত ৩০শে জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে একটি অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে বলে জানায় শহীদ তাইমের ভাই রবিউল আওয়াল। তিনি জানায়, তাইমকে লক্ষ্য করে যখন পুলিশ গুলি চালায়, পেছন থেকে তার বন্ধু রাহাত টেনে নিচ্ছিলেন, বিনা কারণে খুব কাছ থেকে রাহাতকেও গুলি করে পুলিশ। রাহাতের পায়ে গুলি লাগে। ব্যাপক ভাইরাল হয়েছিল সে ঘটনা। মামলায় ১৮ জন আসামির নাম উল্লেখ করলেও মাত্র ২ জন আসামি গ্রেপ্তার, বাকিরা এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন রবিউল।