Image description

প্রশ্ন রেখেই শেষ হলো ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম। আইন অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার নিয়ম থাকলেও, বাস্তবে মিলেছে ভিন্ন চিত্র। নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা কোথাও বাড়ি বাড়ি গেছেন আবার কোথাও যাননি। এ কারণে সম্পূর্ণ নির্ভুল ভোটার তালিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, হালনাগাদের ঘোষিত কর্মসূচি শেষ হলেও নিয়মিত কার্যক্রম চলমান থাকবে। 

সরজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ থেকে স্থানীয়দের ভোটার তথ্য হালনাগাদ করতে অবহিত করা হয়। এজন্য নির্ধারিত স্থানে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়া হয়। এমন তথ্য প্রচার করে এলাকায় এলাকায় মাইকিংও করা হয়। অনেক এলাকায় এভাবেই হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। কর্মীরা বাড়ি বাড়ি খুব একটা যাননি। আবার কোনো কোনো এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ভোটার তালিকা হালনাগাদে তথ্য সংগ্রহকারীও নানাবিধ সমস্যায় পড়েন তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে। বিশেষ করে রাজধানীর অনেক বাড়িতে প্রবেশ করতে না দেয়া, প্রয়োজনীয় তথ্য না দেয়া এবং বিগত সময়ে ভোট নিয়ে নানা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়ায় তথ্য দিতে অনাগ্রহ। এমন অবস্থার মধ্যেই গতকাল শেষ হয়েছে ভোটার তালিকা হালনাগাদের ঘোষিত কার্যক্রম। 
পশ্চিম ধানমণ্ডির সুলতানগঞ্জ রোডের ২৪৪/ক নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করেন মিমি বিশ্বাস। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ করা হবে। কিন্তু আমার বাসায় কোনো তথ্য সংগ্রহকারী আসেনি। এমনকি এমন কার্যক্রম চোখেও পড়েনি। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ২৭২/ক/১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা রেশমা খাতুনও একই অভিযোগ করে বলেন, রোববার পর্যন্ত কোনো তথ্য সংগ্রহকারী আমার বাসায় আসেনি। মাইকিং করে ঘোষণা করতেও দেখিনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীর টাওয়ারের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে কেউ বাসায় আসেনি। তবে এখানে মসজিদে এবং প্রতিটি মোড়ে মাইকিং করে বলে দেয়া হয়েছে। এই ওয়ার্ডের বাসিন্দা কুয়েটের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তন্ময় ভোটার হতে যান শেখদী আব্দুল্লাহ মোল্লা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, এখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে না। কয়েকদিন আগে মসজিদে এবং মহল্লায় মাইকিং করে শেখদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে ভোটার হওয়ার জন্য বলা হয়। 
ঢাকা দক্ষিণ সিটির বাংলামোটর-পরীবাগ এলাকার কয়েকটি হোল্ডিংয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায় সেখানে নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইভা টাওয়ারের মালিক হারুনুর রশিদ বলেন, এই এলাকার কোনো বাসায় কেউ ভোটার হালনাগাদ করতে আসেনি। কয়েকদিন আগে মোমেনবাগে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় যে, শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং মান্নান স্কুলে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। ৬০ নম্বর ওয়ার্ডের নুরপুর এলাকার হাজীপাড়া এইস সোসাইটির বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নওফেল বলেন, আমাদের বাসায় কেউ ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে আসেনি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইব্রাহিম স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শনির আখড়ার নুরপুরে বসবাস করেন। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬০ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তিনি বলেন, এই এলাকায় কেউ ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার জন্য বাড়ি বাড়ি আসেনি। তবে এখানকার মসজিদ ও মোড়ে মোড়ে এ বিষয়ে মাইকিং করা হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের এলাকার কয়েকটি দোকানে এ সংক্রান্ত লিফলেট টানানো হয়েছে। ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের ধোলাইপাড় এলাকার বাসিন্দা নাহিদ বলেন, আমাদের এখানে কেউ বাসায় এসে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেনি। তবে মাইকিং করে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, ধোলাইপাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। একই অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন সবুজবাগ থানার দক্ষিণ রাজারবাগ এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হোসেনও। এ ছাড়া মিরপুরের বি ব্লকের ২০১/এইচ, পশ্চিম কাফরুলের মোল্লাপাড়া ৬৮ নম্বর বাড়িসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি। 

বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রসঙ্গে তথ্য সংগ্রহকারী বর্ণমালা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন, আমি ইসলামবাগ, শাহজালাল বাগ এবং পাটোয়ারি বাগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করছি। আমাদের পক্ষে তো সব বাসায় যাওয়া সম্ভব হয় না। ঢাকায় প্রত্যেকটা বিল্ডিংই হচ্ছে ১০ থেকে ১২ তলা। দেখা যায়, একটি বাড়ি যেতেই দিন পার হয়ে যায়। এই জন্য প্রতিটি বিল্ডিংয়ের দারোয়ানকে লিফলেট দিয়ে এসেছি, যেন বাড়ির সবাই ভোটার তালিকা হালনাগাদ সম্পর্কে জানতে পারে। এ ছাড়া এখানকার প্রতিটা দোকানে আমার নাম্বার সহকারে লিফলেট টানানো আছে। 

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, আইন অনুযায়ী মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা। ইসি’র পক্ষ থেকে মাঠকর্মীদের এমনই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই কার্যক্রমে প্রায় ৬৮ হাজার প্রতিনিধি জড়িত। আমরা সবাইকে এ্যাপ্রোস করার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া এ সংক্রান্ত তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রচার করা হচ্ছে।  

ভোটার হতে পারছেন না ভাড়াটিয়ারা: এদিকে ভোটার হতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ভাড়া বাসায় থাকা বাসিন্দাদের। স্থায়ী বাসিন্দা না হওয়ার কারণে তাদের নাগরিকত্বের প্রত্যয়নপত্র দেয়া হচ্ছে না। দক্ষিণ সিটির ৬২ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এই এলাকার ভাড়াটিয়া বাসিন্দারা। ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের গোবিন্দপুর এলাকার বাসিন্দা তারেক আহমেদ বলেন, আমি এই এলাকায় ১০ বছর ধরে ভাড়া থাকি। আমার বাবা ও মা মারা গেছেন। ভোটার হতে যাওয়ার সময় আমার কাছ থেকে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস থেকে নাগরিকত্বের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে আসতে বলে। আমি যখন নাগরিকত্বের প্রত্যয়নপত্র নিতে যাই, আমাকে কাউন্সিলর অফিস থেকে বলা হয়েছে যে, স্থায়ী বাসিন্দা না হওয়ার কারণে প্রত্যয়নপত্র দেয়া যাবে না। তাহলে আমরা কোথায় যাবো? আমাদের কি ভোট দেয়ার অধিকার থাকবে না। এই এলাকার বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, গোবিন্দপুর এলাকায় ১৫ বছর ধরে ভাড়া বাসায় বসবাস করছি। আমার মেয়ের জাতীয় পরিচয়পত্র করা হয়নি, ভোটার হওয়ার জন্য কাউন্সিল অফিসে গিয়েছিলাম। নাগরিকত্বের প্রত্যয়নপত্র নিতে গেলে স্থায়ী বাসিন্দা না হওয়ার কারণে আমাকে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়নি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে ভিটেমাটি কিছুই নেই। আমরা কি তাহলে ভোটার হতে পারবো না? বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ভোটার হতে পারছি না, এটা দুঃখজনক।

হালনাগাদ কার্যক্রম শেষ হলেও ভোটার হতে পারবে: এদিকে ইসি’র জনসংযোগ শাখার পরিচালক মো. শরিফুল আলমের সই করা এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদ-২০২৫ উপলক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ ৩রা ফেব্রুয়ারি  সোমবার শেষ হচ্ছে। যাদের জন্ম ১লা জানুয়ারি ২০০৮ বা তার পূর্বে কিন্তু কোনো কারণে তথ্য সংগ্রহকারীর মাধ্যমে ফরম-২ পূরণ করতে পারেননি; তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্রে (ছবি তোলার কেন্দ্রে) উপস্থিত হয়ে সরাসরি ফরম-২ পূরণপূর্বক ছবি ও আঙ্গুলে ছাপ প্রদান করে ভোটার হতে পারবেন। এ ছাড়াও তারা অনলাইনে ফরম-২ পূরণ করে ডাউনলোডকৃত কপি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আপনার এলাকার জন্য নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্রে গিয়ে ছবি ও আঙ্গুলে ছাপ প্রদান করে ভোটার হতে পারবেন। নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্রের তথ্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিস থেকে সংগ্রহ করা যাবে।