রাজধানীর চার গুরুত্বপূর্ণ সড়কে পৃথক দাবিতে অবরোধ-বিক্ষোভ চলছে। এর মধ্যে দুই সড়কে সকালে শুরু হওয়া বিক্ষোভ চলে রাত পর্যন্ত। এই অবরোধ আর বিক্ষোভের কারণে তীব্র যানজটে ত্রাহি অবস্থায় পড়েন নগরবাসী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে ছিল যানবাহন। হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে মানুষকে। মানুষের এই দুর্ভোগ লাঘবে কোনো পক্ষকেই দায়িত্বশীল ভূমিকায় দেখা যায়নি। এ কারণে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। নগর জুড়ে দাবি আদায়ের এমন মিছিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানিয়েছেন কেউ কেউ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
সাত দফা দাবি আদায়ে হাতে স্যালাইন, ভাঙা হাতে-পায়ে লোহার খাঁচা লাগিয়ে, ক্রাচে ভর করে শ্যামলী শিশুমেলা মোড়ের মূল সড়কে অবস্থান নিয়েছিলেন জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহতরা। শনিবার সন্ধ্যা থেকে প্রথমে হাসপাতালের অভ্যন্তরে পরে হাসপাতালের সামনের রাস্তায় রাতভর অবস্থান নিয়েও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস না আসায় গতকাল সকাল ১১টার দিকে শিশুমেলায় অবস্থান নিয়ে আশপাশের সড়কের যানচলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন তারা। এতে স্থবির হয়ে পড়ে গাবতলী, মিরপুর, কল্যাণপুর, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, আদাবর, ধানমণ্ডিসহ ঢাকার বেশির ভাগ এলাকা। সরকারের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ না করায় রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আহতরা।
অপরদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে টানা পাঁচদিন ধরে কর্মসূচি পালন করছে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের মহাখালী টু গুলশান-১ এর রাস্তা অবরোধ করে ‘ব্লকেড টু নর্থ সিটি’ কর্মসূচিতে গুলশান, বনানী, মহাখালী, বাড্ডা, লিংক রোডসহ আশপাশের এলাকাতেও চরম যানজটের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও গতকাল দুপুর ১২টার পর থেকে রাজধানীর হাইকোর্ট মাজার চত্বরে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরি হারানো পুলিশ ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। দুপুর পৌনে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এলাকায় জড়ো হয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদতে জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সেইফ এক্সিট দেয়ার প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিসহ চার দফা দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে ইনকিলাব মঞ্চ। একদিকে ইজতেমা শেষে মুসল্লিদের ঢল, অন্যদিকে রাজধানীর রাস্তা দখল করে আন্দোলনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও গন্তব্যে পেঁৗঁছাতে পারেনি অনেকে।
সরজমিন গতকাল সকালে রাজধানীর মিরপুর রোডের শিশুমেলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পঙ্গু হাসপাতালের সামনে অবস্থান নেয়া জুলাই বিপ্লবে আহতরা সকাল সাড়ে ১০টার পর হঠাৎ শিশুমেলা মোড়ে এসে অবস্থান নেন। মূল সড়কের ওপর কেউ চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়েন। কেউ আবার স্টিলের খাঁচা (রিং) লাগানো পা নিয়ে হুইলচেয়ারে বসে, কেউ বেঞ্চে বসে, কেউ আবার হাসপাতালের চেয়ার টেনে এনে মূল সড়কের মাঝে বসে রয়েছেন। কবির হোসেন নামে এক বিক্ষোভকারী বলেন, আমার বাড়ি মিরপুর-১১তে। গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে আমার চোখে গুলি লাগে। এরপর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে চিকিৎসা শেষে আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু বাসায় গিয়ে আমি আবারো অসুস্থ হয়ে পড়ি। আবার হাসপাতালে এলে আমাকে শুধু একটা ড্রপ ও ব্যথার ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু আমি এখনো সুস্থ হইনি। দিন যত বাড়ছে সমস্যা আরও বেশি হচ্ছে। একইসঙ্গে আমাদের পুনর্বাসনেরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আমার মতো এখানে যারা এসেছেন সকলেরই একই অবস্থা। তাই আমদের দাবি, আমাদের কোনো টাকা পয়সা লাগবে না। আমরা উন্নত চিকিৎসা চাই। মো. দুলাল নামে হাতে আঘাত পাওয়া আরেকজন বলেন, আমাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এই সরকার গঠন হয়েছে। এরপরও আমাদের সুচিকিৎসার দিকে কেউ খেয়াল রাখে না। আর এই জন্য তিন মাস আগেও আমরা হাসপাতালের বেড থেকে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করি। সেসময় সরকারের পক্ষ থেকে সুচিকিৎসার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ভালো চিকিৎসা পাইনি। উল্টো গতকাল রাত থেকে আমরা রাস্তায় বসে থাকলেও এখন পর্যন্ত কেউ খবর নেয়নি। তাই এখন আর আমরা কাউকে ভরসা করি না। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাস্তা ছাড়বো না। শিশুমেলা মোড়ের ফুটওভার ব্রিজের কাছে বুকে পোস্টার ঝুলিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, হয় আমাদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে, না হয় আমাদের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে। ৫ই আগস্ট বাম চোখে গুলিবিদ্ধ কুষ্টিয়ার কোরবান শেখ বলেন, হাসিনার মতো ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি। দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে কখনো পরিবারের দিকে তাকাইনি। আর এখন আমাদেরই কোনো মূল্য নেই। যে যার যার আখের গোছাতে ব্যস্ত। আমরা সুচিকিৎসার দাবিতে শনিবার সন্ধ্যা থেকে প্রথমে হাসপাতালের ভেতর ও পরে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলেও এখনো কেউ খবর নেয়নি। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাস্তা ছাড়বো না।
এদিকে শিশুমেলার মতো গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করে রাখায় পুরো শ্যামলী টু আগারগাঁও, আগারগাঁও টু কলেজগেট ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গাবতলী হয়ে ঢাকায় প্রবেশ একই সঙ্গে ঢাকা থেকে বের হওয়া মিরপুর রোডে যানচলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। টেকনিক্যাল মোড় দিয়ে পুলিশ ঢাকার বাইরে থেকে আসা কিছু যানবাহন ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও অধিক চাপে স্থবির হয়ে যায় পুরো মিরপুর এলাকা। দিনভর অপেক্ষার পরও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি শ্যামলী শিশুমেলায় আটকে থাকা যানবাহন। কর্মজীবী মানুষের পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়েন শেরে বাংলা নগরের হৃদরোগ, কিডনি ফাউন্ডেশন, শিশু হাসপতাল, সোহ্রাওয়ার্দী হাসপতাল, টিবি, চক্ষু, পঙ্গুসহ বিভিন্ন হাসপতালে চিকিৎসা নেয়া শত শত রোগী। এমনই একজন আজিজুল হক। হৃদরোগে আক্রান্ত এই রোগী বলেন, আমি ইকো পরীক্ষা করানোর জন্য ফার্মগেট থেকে বাসে উঠেছিলাম। বাসে উঠে দেখি বাস আর সামনের দিকে এগুচ্ছে না। এরপর নেমে হাঁটা শুরু করি। সেখান থেকে প্রথমে কল্যাণপুর একটি হাসাপাতালে যাই ইকো পরীক্ষার জন্য। এখন আবার কল্যাণপুর থেকে হেঁটে শ্যামলী এসেছি। এখন আর হাঁটতে পারছি না। অসুস্থ হয়ে পড়েছি। তিনি বলেন, দাবি আদায়ে এভাবে রাস্তা বন্ধ করার কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না। আমার মতো শত শত মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। নূর আলম নামে আরেকজন বলেন, সকালে বাচ্চাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য শিশু হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম। এখন ঘণ্টাখানিকের বেসি সময় ধরে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু কিছুই পাচ্ছি না। সব বন্ধ। এই ৭ বছরের অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে হেঁটে যাওয়াও কষ্টকর। তবুও হেঁটে হেঁটেই গাবতলী যেতে হবে। সেখান থেকে সাভার ফিরবো। বেসরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা দিতে গতকাল মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা শরীফ হাসান বলেন, অনেক চেষ্টার পর একটা বেসরকারি কোম্পানিতে নিয়োগের ডাক পেয়েছিলাম। আজকে দুপুর ১টার মধ্যে আমাকে মতিঝিল থাকতে হবে। কিন্তু গাবতলীতে বাস থেকে নেমে দেখি পুরো রাস্তায় জ্যাম। কোনো গাড়ি সামনে যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে মানুষের কাছে শুনে শুনে পায়ে হেঁটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। তবুও মনে হয় সঠিক সময়ের মধ্যে আমি মতিঝিলের অফিসে পৌঁছাতে পারবো না। অশ্রুসিক্ত হয়ে তিনি বলেন, চাকরিটা খুব দরকার। এই যানজটে সময়মতো উপস্থিত হতে না পারলে চাকরিটা আমার হবে না। নাজমা বেগম নামে এক নারী বলেন, দুই বাচ্চাকে নিয়ে আমি আজিমপুর থেকে ব্যাগ-পত্র নিয়ে গাবতলী বাস টার্মিনালে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম। কিন্তু শিশুমেলায় সব গাড়ি আটকে রেখেছে। তাই বাস থেকে নেমে এই ব্যাগ ও বাচ্চাদের নিয়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছি। চরম বিড়ম্বনার মধ্যে আছি। এখন কতক্ষণে গাবতলী পৌঁছাবো তাও জানি না। আন্দোলনকারীদের ঠিক পেছনে দিনভর দাঁড়িয়ে থাকা আলিফ, মৌমিতা, ঠিকানা, নীলাচলসহ বিভিন্ন সিটি সার্ভিস বাসের চালকেরা বলেন, বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ এসে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হলো। প্রতিদিনই কেউ না কেউ তাদের দাবি নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রাস্তা অবরোধ করছে। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে এভাবে একের পর এক আন্দোলন হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সারা দিন দাঁড়িয়ে থেকে উল্টো ধার-কর্য করে মহাজনকে গাড়ির জমার টাকা দেয়া লাগে আমাদের। না খেয়ে পরিবার নিয়ে দিন পার করলেও কেউ আমাদের খবর নেয় না। আমরা এসব থেকে মুক্তি চাই। কাজ করে খেতে চাই। এসব রাস্তা দখলকারীদের বিরুদ্ধে যেন প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
এদিকে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দিতে টানা পঞ্চমদিনের মতো অনশন কর্মসূচি পালন করছে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাতভর গুলশান-১ নম্বর এলাকায় অবস্থানের পর গতকাল সকাল থেকে মহাখালীর রেলপথ ও আমতলীর ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে ও আশপাশের সড়ক অবরোধের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। সকাল ১১টার পর তিতুমীর কলেজের সামনের রাস্তায় বাঁশ বেঁধে যানচলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন তারা। এতে পুরো গুলশান, মহাখালী, বনানীসহ আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শেষে ঢাকা ফেরত মুসল্লিদের ঢল শুরু হলে একপর্যায়ে নিজেদের ‘ব্লকেড টু নর্থ সিটি’ কর্মসূচি শিথিল করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলন করা তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। সাধারণ মানুষের যানবাহন তো দূরের কথা, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি সদস্যদের টহল গাড়ি পর্যন্ত যেতে দেয়নি শিক্ষার্থীরা। আবু বক্কার নামের এক সিএনজিচালক বলেন, এই রাস্তা দিয়ে আসছি গুলশান-১ যাওয়ার জন্য। কিন্তু যেতে পারলাম না। এখানে যাত্রী নেমে গেছে। ১০০ টাকা কম দিয়ে গেল। এটা যাত্রীদের জন্য ভোগান্তির, আমাদের জন্যও ভোগান্তির। কলেজের গেটে যানবাহন ঘুরিয়ে দেয়ার সময় শফিকুল নামের আরেক পাঠাও চালক বলেন, এই রাস্তা বন্ধের কারণে এখন কয়েক কিলোমিটার পথ ঘুরে যেতে হবে। এভাবে রাস্তা আটকালে আমাদের চলাফেরা করা কঠিন হয়।