টাঙ্গাইলে এক যুগ আগে আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যার বিচারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে তার পরিবার। তারা বলছেন, আইন কর্মকর্তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি।
রোববার দুপুর ৩টায় টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মাহমুদুল হাসান আলোচিত এ হত্যা মামলার রায়ে খান পরিবারের চার ছেলেসহ দশজনকে খালাস দিয়েছে আদালত। যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে দুইজনের।
এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ফারুক আহমেদের ছেলে আহমেদ মজিদ সুমন বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে আসামিরা বিচারপ্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। এই মামলার আসামিদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী নেতারা।
“তারা ৫ অগাস্টের পর আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এসব আইন কর্মকর্তা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। এর আগেও যারা ছিলেন, তারা আসামিদের ভয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।”
২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ফারুক আহমেদের গুলিবিদ্ধ লাশ তার কলেজপাড়ার বাসার কাছ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। দীর্ঘ ১২ বছর অপেক্ষার পর এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি পরিবার।
রায় ঘোষণার সময় আসামিদের মধ্যে কেবল খান পরিবারের ছেলে সহিদুর রহমান খান মুক্তি উপস্থিত ছিলেন। অন্য একটি মামলায় গ্রেপ্তার টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক এ মেয়রকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করে পুলিশ।
যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত দুজন হলেন, মোহাম্মদ আলী ও কবির হোসেন। একই সাথে প্রত্যেককে পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদন্ডের আদেশও দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তারা দুইজনেই পলাতক রয়েছেন।
রায়ে ‘ন্যায়বিচার’ পেয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন আসামীপক্ষের আইনজীবী নাসির উদ্দিন খান। তিনি বলেন, এই মামলায় ২৭ জনের সাক্ষ্য রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করেছিল। কেউ প্রমাণ করতে পারেনি যে, আসামিরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। যখন ঘটনা দেখানো হয়েছিল, তখন সহিদুর রহমান খান মুক্তি সস্ত্রীক ভারতে ছিলেন চিকিৎসার জন্য; তার ভাই কাকন মালয়েশিয়াতে ছিলেন, সাবেক এমপি রানা ঘাটাইলে একটি অনুষ্ঠানে ছিলেন এবং তাদের ছোট ভাই বাপ্পা ঢাকায় ছাত্রলীগের কার্যালয়ে ছিলেন।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছিল। এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়েছি।”
টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁশুলি মোহাম্মদ সাইদুর রহমান স্বপন বলেন, “যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনকালে ২৭ সাক্ষীর জবানবন্দি, জেরা, কয়েকজন আসামি ও সাক্ষীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করে আদালতকে শোনানো হয়। সেই অনুযায়ী বিচারক রায় দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “এই মামলায় বাদীর পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে আপিলের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
মামলা সূত্রে জানা যায়, ঘটনার তিন দিন পর ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার আহমেদ টাঙ্গাইল সদর থানায় মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।
২০১৪ সালে এই মামলায় জড়িত থাকা সন্দেহে আনিছুল ইসলাম ওরফে রাজা এবং মোহাম্মদ আলী নামের দুজনকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাদের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে এই হত্যা মামলার সঙ্গে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা, তার তিন ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সহিদুর রহমান খান ওরফে মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান ওরফে কাঁকন এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সহসভাপতি ছানিয়াত খান ওরফে বাপ্পা জড়িত থাকার বিষয়টি বের হয়ে আসে।
তদন্ত শেষে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এতে সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান ও তার তিন ভাইসহ ১৪ জনকে আসামি করা হয়। ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এরমধ্য দিয়েই বিচার কাজ শুরু হয়।
এই মামলার আসামি আমানুর রহমান খান আত্মসর্মপণের পর তিন বছর কারাগারে ছিলেন। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন। গত বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
তার অপর ভাই সাবেক পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান ফারুক হত্যা মামলায় জামিন পেলেও এখন অন্য মামলায় কারাগারে আছেন। অন্য দুই ভাই জাহিদুর, সানিয়াত এবং আসামি মোহাম্মদ কবির পলাতক রয়েছেন। দুই আসামি আনিছুর রহমান রাজা ও মোহাম্মদ সমির কারাগারে মারা গেছেন। জামিনে রয়েছেন মোহাম্মদ আলী, মাসুদুর রহমান, নাছির উদ্দিন নুরু, ফরিদ আহমেদ, ছানোয়ার হোসেন ও বাবু।
খান পরিবারের কে কোথায়
রাজনৈতিক পটরিবর্তনের পর আমানুর রহমান খান রানা আত্মগোপনে যান। তার অপর দুই ভাই ২০১৪ সাল থেকে বিদেশে অবস্থান করছেন বলে তাদের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন। রানার আরেক ভাই সাবেক পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি অন্য একটি মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
রানার বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যা মামলাসহ অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। সহিদুর রহমান খান মুক্তির বিরুদ্ধেও পাঁচটি হত্যাসহ অন্তত ৪০টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া জাহিদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা এবং সানিয়াত খান বাপ্পার বিরুদ্ধে চারটি হত্যাসহ ডজন খানেক মামলা হয়েছে।
এত মামলা হলেও তাদের কখনো বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। কখনও তাদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার হয়েছে। আবার কখনও আসামিদের চাপে বাদীপক্ষ মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের ভয়ে কেউ কখনো আদালতে সাক্ষ্য পর্যন্ত দিতে যায়নি। এই চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় হত্যা, চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা থাকলেও এর আগে কোনোটিরই রায় হয়নি। এই চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো যে মামলার রায় হলো, তাতে তারা সবাই খালাস পেলেন।